অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, ঝরছে তাজা প্রাণ
একটি জীবন শুধু একজন মানুষের একক জীবন নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক মানুষের জীবন। একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে তখন অন্য জীবনেও নেমে আসে যন্ত্রণা। সম্প্রতি অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণেও রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। কখনও বাসের সঙ্গে, কখনও মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেই চলছে।
একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিশ টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারও ভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। একের পর এক লেভেলক্রসিংয়ে প্রায়ই ঝরছে মানুষের তাজা প্রাণ।
নীলফামারী জেলার ৬৩ কিলোমিটার রেলপথে ৩৩টি লেভেলক্রসিং থাকলেও এখানে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাত্র ২১টিতে। বাকি ১২টি অরক্ষিত ও তিনটি অবৈধ ক্রসিং। ফলে নীলফামারী জেলায় একের পর এক বাড়ছে এ অসহনীয় মৃত্যুর মিছিল। গত দুই মাসে এ রেলপথে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে দারোয়ানীতে লেভেলক্রসিংয়ে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে উত্তরা ইপিজেডের চার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছেন অটোরিকশার চালকসহ আরও পাঁচ শ্রমিক। নিহত চার পরিবারের মধ্যে শেফালির দুটি সন্তান, রোমানা বেগমের তিন মেয়ে, মিনারার এক ছেলে এবং সায়েরার দুটি সন্তান রয়েছে। পরিবারের সচ্ছলতার জন্য স্বামীর রোজগারের পাশাপাশি ইপিজেডে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন নিহত নারীরা।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উত্তরা ইপিজেডের সনিক কারখানার শ্রমিক রওশন আরা (৩৪) জানান, বাড়ি থেকে সাড়ে ৬টাই বের হই। আমরা যে অটোতে যাচ্ছিলাম অটোওয়ালা ট্রেনের হুইসেল শুনতে পারেনি সে কারণে এই ঘটনা ঘটে। ট্রেনে ধাক্কার সাথে সাথে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ি আমরা। পরে আর কিছুই জানি না।
এর দেড় মাস আগে ৮ ডিসেম্বর জেলা শহরের বউবাজার এলাকায় চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী খুলনা মেইল ট্রেনে কাটা পড়ে একই পরিবারের তিন শিশুসহ মারা যান চারজন। ওই স্থানে রেললাইন পারাপারের জন্য একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছিল। নির্মাণ কাজের জন্য ইট নিয়ে একটি ট্রাক এলে সেটি দেখতে যায় শিশুরা। এ সময় খুলনা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামী রকেট মেইল ট্রেন তাদের সামনাসামনি চলে আসে। পরে প্রতিবেশী শামীম ওই তিন ভাই-বোনকে বাঁচাতে গেলে তিনিও ট্রেনে কাটা পড়েন।
রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে কর্মকর্তা বলছেন, প্রধানত অসতর্কতা ও বেপরোয়া পারাপারের কারণে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টরা এসব মৃত্যুর জন্য প্রায় ১০টির মতো কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে অরক্ষিত ক্রসিং, অসতর্কতা, বাঁকা পথের কারণে ট্রেন দেখতে না পাওয়া, রেললাইন ধরে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা, লাইনের দুপাশে দোকান-বাজার বা অবৈধ স্থাপনা, সিগন্যালে দায়িত্বরত লোক না থাকা অন্যতম।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ক্রসিংয়ের উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নেয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। অবশেষে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ রেলপথের এসব ক্রসিং দিয়ে অবাধে পারপার করছে হাজারো পথচারী ও বিভিন্ন যানবাহন। রেল বিভাগ ক্রসিংয়ের দুই পাশে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লিখে দিয়েছে ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নেই। পথচারী ও সকল প্রকার যানবাহন চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার হবেন।’ আবার অন্য সতর্কবার্তায় লেখা হয়েছে, ‘এই স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।’
স্থানীয়রা জানান, এ রেলপথে ১২টি অরক্ষিত ও তিনটি অবৈধ ক্রসিং অতিক্রমের সময় ট্রেনের গতি কমানো হয় না। এমনকি ট্রেনের হুইসেল পর্যন্ত বাজানো হয় না। ক্রসিংগুলো অতিক্রম করার সময় মানুষ বা যানবাহন পারাপারের বিষয়টি ট্রেনের চালকের দৃষ্টিতে এলেও ব্রেক পর্যন্ত ধরা হয় না। এতে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে রেল বিভাগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জানতে চাইলে সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান বলেন, মানুষকে সচেতন হতে হবে আর যেখানে সেখানে রাস্তা বানানো বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে রেলপথের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব। এসব ক্রসিংয়ে নেই নিরাপত্তাকর্মী ও সংকেত বাতি। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে কোনো কোনো সময় ট্রেন হুইসেল না দিয়েই চলে যায়। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায় ওই এলাকায়। এতে সুনাম নষ্ট হচ্ছে রেল বিভাগের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে রেলের দায়বদ্ধতা নেই। কারণ যানবাহন চলাচলে রেললাইন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য যানবাহন ও মানুষ পারাপারের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ সড়ক বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে। কিন্তু লেভেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের উদ্যোগ নেই।
শরিফুল ইসলাম/এমএসআর