এক বছরে নারায়ণগঞ্জে ৬৯৪ অগ্নিকাণ্ড
২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় মোট ৬৯৪টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি ৪৯ লাখ ৪ হাজার ২৪০ টাকা। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় অগ্নিকাণ্ডের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫৮ কোটি ৬৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮০ টাকার সম্পদ। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৬৬ জন নিহত ও ১০৬ জন আহত হয়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডারের অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন ১০ জন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, যানবাহনের দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ৮টি। এতে সম্পদ পুড়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার। উদ্ধার হয়েছে সাড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টাকার সম্পদ। অজ্ঞাত কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা ১৬৫টি। ক্ষতি ৫৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। সম্পদ রক্ষা ৫ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকার। গ্যাস লাইনের আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ড ৯৮টি। জানমালের ক্ষতি ২০ লাখ ৬৯ হাজার টাকার। ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার সম্পদ রক্ষা। সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১৫টি। ক্ষতি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সম্পদ উদ্ধার ৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকার।
রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একটি। ক্ষতি ৩০ হাজার টাকা, সম্পদ রক্ষা ৩ লাখ টাকার। স্থিরবিদ্যুতে অগ্নিকাণ্ড একটি। ক্ষয়ক্ষতি নেই। স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্জ্বলনে অগ্নিকাণ্ড দুটি। ক্ষতি ৫ লাখ টাকার। ৫ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা। মেশিনের মিস ফায়ার থেকে অগ্নিকাণ্ড দুটি। ক্ষয়ক্ষতি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার। ২৫ লাখ টাকার সম্পদ রক্ষা। মাত্রা অতিরিক্ত তাপ বা উচ্চ তাপে অগ্নিকাণ্ড ১০টি। ক্ষয়ক্ষতি ৯০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৮ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ রক্ষা।
সূত্র মতে, বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড দুটি। ক্ষতি ৩০ হাজার টাকা। ৩০ হাজার টাকার সম্পদ রক্ষা। শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক অগ্নিসংযোগ থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড দুটি। ক্ষতি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার। ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ রক্ষা। যন্ত্রাংশে ঘর্ষণজনিত কারণে অগ্নিকাণ্ড ১৮টি। ক্ষতির পরিমাণ ৩১ লাখ টাকা। ৯০ লাখ টাকার সম্পদ উদ্ধার। উত্তপ্ত ছাই কিম্বা জ্বালানি থেকে অগ্নিকাণ্ড ৮টি। ক্ষতি ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। ১৭ লাখ টাকার সম্পদ রক্ষা। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে অগ্নিকাণ্ড ১২৪টি। ক্ষতি ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। সম্পদ রক্ষা ৪ কোটি ৮৬ লাখ ৫ হাজার টাকা।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড ১৮৬টি। এতে ১২ কোটি ৬২ লাখ ৬৬ হাজার টাকার সম্পদের ক্ষতি। সম্পদ রক্ষা ২৩ কোটি ৪৬ লাখ ৮ হাজার টাকা। ইলেক্ট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড ৫৩টি। ক্ষতির পরিমাণ ৫০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ রক্ষা।
২০২০ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৫৯৪ টি। ২০২১ সালে মাসিক অগ্নিকাণ্ডের হার বেশি। সেই সঙ্গে আহত ও নিহতের সংখ্যাও আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। ২০১৯ সালে আহত হন ২৭ জন এবং নিহত হন ৫ জন। ২০২০ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হন ১৬ জন এবং নিহত হন ৩৯ জন।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডের ৯০ শতাংশ ঘটনায় ৪টি গুরুতর কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ, চুলার আগুন, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো ও গ্যাস লাইনের আগুন থেকেই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জেলায় মাত্রা অতিরিক্ত অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও সমাধানের বিষয়ে বলেন, নারায়ণগঞ্জ শিল্পে পরিপূর্ণ একটি নগরী। এখানে বড় পরিসরে কলকারখানার কার্যক্রম চলে। এ ধরনের অঞ্চলে পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন না করা হলে প্রচুর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত বছরের প্রথম সাত মাসে সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইনের কারণে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি তিন মাস পরপর বৈদ্যুতিক সংযোগ ঠিক আছে কিনা তদারকি করা উচিত। একইভাবে তিতাসের গ্যাস লাইনের কার্যক্ষমতা ও পরিস্থিতি নিয়ে তদারকি করা প্রয়োজন। কিন্তু এমনটা হয় না। বছরের পর বছর চলে যায় এসব লাইনের মেরামত বা কার্যক্ষমতা নিরীক্ষা করা হয় না। ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ ও সুইচবোর্ডের কারণে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে। অধিকাংশ ঘটনা মানুষের অসচেতনতার কারণে ঘটছে। মানুষের মাঝে সচেতনতার পাশাপাশি বহুতল ভবন ও সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এসব ঘটনা হ্রাস পাবে।
গত বছরের ৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার সজিব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এদের মধ্যে ৪৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় ১০ জুলাই একটি হত্যা মামলা করেন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। এ মামলায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হাসেমসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মর্মান্তিক এ ঘটনার রেস কাটার আগেই আগস্ট মাসের শুরুতে রূপগঞ্জে আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ৪ আগস্ট উপজেলার তারাবো পৌরসভার মৈকুলী এলাকার এম হোসেন কটন অ্যান্ড স্পিনিং মিলের ইউনাইটেড লেদারের ক্যামিকেলের গোডাউনে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট। তবে অগ্নিকাণ্ডে কোনো প্রকার হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের বেশিরভাগ মার্কেট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই চলছে। এ তালিকায় যেমন সিটি করপোরেশনের মার্কেট রয়েছে, তেমনি রয়েছে নাম করা বেসরকারি মার্কেটও। ইতোমধ্যেই এমন ১৫টি মার্কেটকে চিহ্নিত করে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের ৭৫টি বিপণীবিতান পরিদর্শন করে অগ্নি ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এর মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে ২০টি মার্কেট।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কেটগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। কোনো নিয়ম-নীতিই মানা হচ্ছে না। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই, পানি নেই, নেই ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। মার্কেটের ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, বিদ্যুতের সাবস্টেশন সব এক জায়গায় করা। বার বার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হলেও প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
রাজু আহমেদ/আরএআর