নকশায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাক্ষী ষাটগম্বুজ মসজিদ
নকশা আর কারুকার্যে খচতি ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ। হজরত খানজাহান আলী (র.) কর্তৃক নির্মিত প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো বিশালায়তন অপূর্ব এই মসজিদটির অবস্থান দক্ষিণের অন্যতম জেলা বাগেরহাটে। সুলতানি আমলের অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই মসজিদ বাগেরহাট শহরের অন্যতম আকর্ষণ। বাগেরহাটের নামের সঙ্গে ষাটগম্বুজ মসজিদের নাম মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে।
বাগেরহাট শহরতলির সুন্দরঘোনা বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত মসজিদটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে একটি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি একজন কাস্টোডিয়ানের অধীনে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর দেখভাল করে থাকেন।
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সরকার-নির্ধাতির রাজস্ব দিয়ে টিকিট কেটে মসজিদটি ঘুরে দেখতে পারেন। তবে মসজিদটিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের টিকিট ছাড়াই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার সুযোগ রয়েছে।
যেভাবে নামকরণ
ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’-এর ওপর গম্বুজ থাকায় এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ হয়েছে। আবার কারও মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে ১০টি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার ওপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। কারও মতে, মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গম্বুজ আকৃতির। সেই থেকে মসজিদটি ‘ছাদগম্বুজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরূপে ‘ষাটগম্বুজ‘ নাম হয়েছে।
মসজিদের বিবরণ
মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোনের মিনার বা বুরুজের ওপরের ৪টি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজের সংখ্যা ৭৭। এর মধ্যে ৭০টি গম্বুজের উপরিভাগ গোলাকার এবং মসজিদের মাঝ-বরাবর গোলাকার গম্বুজগুলোকে ৭টি চার কোনাবিশিষ্ট গম্বুজ দিয়ে সংযোগ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোনের বুরুজটির ভেতর দিয়ে ওপরে বা ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে। এর নাম ‘রওশন কোঠা। আর উত্তর-পূর্ব কোনের বুরুজটি দিয়েও ওপরে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। এর নাম আন্ধার কোঠা নামে পরিচিত।
নির্মাণকাল
১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে সুদূর দিল্লির জৌনপুর থেকে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে এই অঞ্চলে আগমন করেন মহান সাধক হজরত খানজাহান (রহ.)। ইসলাম ধর্মের প্রচারক সেনাপতি হজরত খানজাহান আলী (র.) ৫৭৩ বছর পূর্বে খলিফাতাবাদ (বর্তমান বাগেরহাট) রাজ্যের রাজধানীতে এটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক গবেষক ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মতে ১১৪০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আজকের এই পুরাকীর্তি নির্মাণে সময় লেগেছিল ১০ থেকে ১২ বছর।
জনশ্রুতি আছে যে হজরত খানজাহান (রহ.) ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদূর চট্টগ্রাম আবার কারও মতে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে অলৌকিক ক্ষমতাবলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। পুরো মসজিদ তৈরির মূল উপাদান চুন, সুরকি, কালোপাথর ও ছোট ইট। এই মসজিদের স্থাপত্যকলার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুঘলক (তুরস্ক) স্থাপত্যশৈলীর মিল রয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
সময়সূচি
ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারেন ষাটগম্বুজ মসজিদ চত্বরে। তবে জাদুঘরে প্রবেশের সময়সীমা ভিন্ন। গরমকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারে জাদুঘরে। কিন্তু দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত জাদুঘর বন্ধ রাখা হয়।
টিকিট মূল্য
পাঁচ বছরের অধিক প্রত্যেকের জন্য ষাটগম্বুজ মসজিদ চত্বরে প্রবেশ ফি বাধ্যতামূলক। দেশি পর্যটকদের জন্য ফি ২০ টাকা। বিদেশি পর্যটকদের জন্য ২০০ টাকা। তবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ১০০ টাকা।
দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত
দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ পবিত্র ঈদের জামাত ষাটগম্বুজ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ষাটগম্বুজ মসজিদে পবিত্র ঈদের প্রধান জামাতে দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধলক্ষ মুসল্লি অংশ নেয়।
আবাসনব্যবস্থা
বাগেরহাট শহরে এসি/নন-এসি বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। আরও আছে সরকারি গেস্ট হাউস। এ ছাড়া খান জাহান আলী মাজার সংলগ্ন হাইওয়েতে কিছু হোটেল আছে। বাগেরহাট শহর থেকে খুলনা শহর মাত্র এক ঘণ্টার পথ। সে ক্ষেত্রে দর্শনার্থীরা বাগেরহাট ঘুরে খুলনায় এসেও থাকতে পারেন।
নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান
ষাটগম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই পূর্ব পাশে রয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত আছে খান জাহান আমলের বিভিন্ন নিদর্শন। মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘোড়া দিঘি, যা দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোনে রয়েছে কোদাল ধোয়া দিঘি। উত্তরে ৩০০ মিটার দূরে রয়েছে খানজাহানের বসতভিটা বা ঢিবি। খানজাহান আলীর মাজার দরগাহ রয়েছে ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে শহরের দিকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রায় ৫০০ মিটার পেছনে রয়েছে বিবি বেগনির মসজিদ। বিবি বেগনির মসজিদের ৫০০ মিটার পেছনের দিকে রয়েছে চুনাখোলা নামের আরেকটি মসজিদ। এ ছাড়া মহাসড়কের পাশে রয়েছে সিঙ্গাইর মসজিদ।
খান জাহানের আমলের অন্যান্য স্থাপনা
বাগেরহাটে খানজাহানের আমলে নির্মিত অন্য সব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে এক গম্বুজ মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, রণ বিজয়পুর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, জিন্দা পীরের মসজিদ, খান জাহান আলী (রহ.)-এর সমাধি, পীর আলী তাহেরের সমাধি, জিন্দা পীরের সমাধি, সাবেক ডাঙ্গা প্রার্থনা কক্ষ, খান জাহান আলী (রহ.)-এর বসতভিটা, বড় আদিনা ডিবি, খান জাহানের তৈরি প্রাচীন রাস্তা।
ষোড়শ শতাব্দীতে খানজাহান আমলে নির্মিত ইসলামী স্থাপত্যরীতির এসব মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ঘোষণা এবং ৩২১তম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির বাস বাগেরহাট শহরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোতে ষাটগম্বুজ মসজিদ যাওয়া যায়। অটো বা গাড়ি থেকে নেমেই রাস্তার পাশে ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখা যায়। এ ছাড়া ট্রেনে খুলনা এসে সেখান থেকেও বাগেরহাট আসা যায়।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলে মাত্র এক দিনের বাগেরহাট থেকে ঘুরে ঢাকায় ফিরতে পারবেন দর্শনার্থীরা।
বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ ঢাকা পোস্টকে জানান, আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় ষাটগম্বুজ মসজিদ। এটি হজরত খান জাহান (রহ.)-এর সর্ববৃহৎ কীর্তি বা নিদর্শন। মসজিদটিকে আরও নান্দনিক করে গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ষাটগম্বুজের সামনের বিশ্রামাগার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদ-সংলগ্ন ঘোড়াদিঘির পাশ দিয়ে ওয়াক ওয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাটে জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ষাটগম্বুজ মসজিদ ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে একটি এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যটন আকর্ষণসমূহের একটি। এটি সুলতানি আমলের বৃহত্তম ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর মধ্যেও অন্যতম। এই মসজিদ বাগেরহাটবাসীর জন্য গর্বের ও সম্মানের।
তিনি আরও বলেন, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বাগেরহাটকে পর্যটনবান্ধব করতে প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রের শোভাবর্ধন, আবাসনব্যবস্থা, মানসম্মত খাবার, বিপণন কেন্দ্র, সহজ যাতায়াত, সার্বিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। অচিরেই বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই জেলা প্রশাসক।
এনএ