৫০ পরীক্ষা দিয়েও চাকরি না হওয়ায় রাস্তায় নামলেন যুবক
একে একে ৫০ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া। অনেক স্বপ্ন, দীর্ঘ প্রত্যাশা। কিন্তু এখনো মেলেনি চাকরির দেখা। তারপরও চেষ্টা দমে যায়নি। তবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীত আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ছোবলে বেড়েছে হতাশা। তাই চাকরি নামক সোনার হরিণে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতিমুক্ত করার দাবি মাস্টার্স পাস করা রেজওয়ান কবির রনির।
শিক্ষিত যুবসমাজকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুখে কালি মেখে ভিন্নরকম প্রতিবাদে নেমেছেন ২৮ বছর বয়সী এই যুবক। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাই করছেন প্রতিবাদী পদযাত্রা।
মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে মুখে কালি আর বুকে-পিটে সাঁটানো পোস্টার নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায় রেদওয়ান কবির রনিকে। ২০১৮ সালে কারমাইকেল কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছেন প্রতিবাদী এই যুবক।
হঠাৎ মুখে কালি মেখে কেন এমন প্রতিবাদ? এর কারণ হিসেবে রেজওয়ান কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ২০১৪ সাল থেকে সরকারি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি। একে একে ৫০টির মতো পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত ও মৌখিকে ভালো হলেও ভালো যোগাযোগ আর তদবির না থাকায় চাকরি মিলছে না।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম তো রয়েছে। সবমিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে মেধার মূল্যায়ন কম হচ্ছে। এখন মাস্টার্স পাস করেও যদি চাকরি না পাই. তাহলে কার কাছে ন্যায় বিচার চাইব? এ কারণে চাকরির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে একাই প্রতিবাদে মেনেছি।
চাকরিপ্রত্যাশী এই যুবক বলেন, ‘খাদ্য অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, পরিসংখ্যান ব্যুরো, কারিগরি, জীবন বীমা করপোরেশন, আমদানি-রফতানি অধিদফতর, অডিটর, সমাজসেবা, নিবন্ধন ও বিভিন্ন ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত ভালো হলে ভাইভায় বাদ যাই। আবার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ভালো হওয়ার পরও তদবিরে পিছিয়ে পড়ে চাকরি হয়নি। কিন্তু আমি তদবিরে বিশ্বাসী না বরং মেধার মূল্যায়নে চাকরি চাই।’
এখনো চাকরির চেষ্টা করছেন জানিয়ে রেজওয়ান কবির বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদফতরে পরীক্ষার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করেও পরীক্ষা দিতে পারিনি। কারণ আগের দিনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এর আগে খাদ্য অধিদফতরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও পরীক্ষা বাতিল হয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পরীক্ষা দিয়েছি। সেখানে লিখিত থেকে মৌখিক সবই ভালো হয়েছে। কিন্তু মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ দেখায়নি। সবশেষ মৎস্য অধিদফতরের লিখিত পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এখন মৌখিক বাকি রয়েছে। আমি হাল ছাড়িনি।’
দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব দাবি করা এই যুবকের বিশ্বাস, জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন হলে সকল চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের রীতি বন্ধ হবে। এ জন্য সরকার প্রধানসহ সকলকে আরও বেশি আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) সকালে প্রথম রংপুর নগরের লালবাগ এলাকায় প্রতিবাদী পোস্টার নিয়ে অবস্থান করেন রেজওয়ান কবির। সেখান থেকে পদযাত্রা করে শাপলা চত্বর, গ্রান্ড হোটেল মোড় হয়ে প্রেসক্লাব চত্বরে আসেন তিনি।
এরপর সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর পায়ে হেঁটে জাহাজ কোম্পানী, পায়রা চত্বর, সিটিবাজার মোড়, পুলিশ লাইন মোড়, কাচারী বাজার হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে পদযাত্রা কার্যক্রম শেষ করেন। এর আগে কখনো এভাবে একাই এমন ভিন্ন রকমের প্রতিবাদ করেননি রেজওয়ান কবির রনি।
রেজওয়ান কবির রনি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মাদারগঞ্জ একদারপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মা রাহেলা বেগম। পরিবারের চার ভাই-বোনের মধ্যে রেজওয়ান কবির সবার ছোট। বাকি তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে রেজওয়ান কবিরের বাবা বেকার। তিনি স্থানীয় একটি এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে ২০১২ সালে অবসরে যান। এরপর একমাত্র ছেলে হিসেবে পড়ালেখার পাশাপাশি রেজওয়ান কবিরকে ধরতে হয় বাবার সংসারের হাল।
স্থানীয় মাদারগঞ্জ বিএল উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রনি। এরপর ২০১১ সালে মাদারগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন রংপুর সরকারি কলেজে। সেখানকার অর্থনীতি বিভাগ থেকে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (অনার্স) শেষ করেন রেজওয়ান কবির। ২০১৭ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন তিনি।
এমএসআর