পোড়া গন্ধে কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখি জ্বলছে পুরো লঞ্চ
‘পোড়া গন্ধ পেয়ে আমি ভিআইপি কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে দেখি দাউদাউ করে লঞ্চে আগুন জ্বলছে। করিডোর থেকে বারবার বাইরে দেখছিলাম। আগুনের আলোতে দেখি লঞ্চ তীরে ভিড়ছে। চিৎকার দিয়ে সবাইকে বললাম লঞ্চ চরে ভিড়ছে, সবাই দ্রুত নামুন। এরপর শখানেক যাত্রী স্বাভাবিকভাবেই তীরে নামে। প্রথম দিকে সহজেই নামতে পারা ১০-১৫ জন যাত্রীর মধ্যে পরিবারসহ আমিও নামতে পেরেছিলাম।’
কথাগুলো বলছিলেন অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চেয়ে সর্বপ্রথম লঞ্চ থেকে বার্তা ছড়ানো ইতালিপ্রবাসী সাদিকুর রহমান (৩৫)। অগ্নিকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ৫১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের ফেসবুক লাইভ করেন তিনি। আগুন থেকে বাঁচাতে ডেক ও কেবিনের ঘুমন্ত যাত্রীদের তিনি চেষ্টা করেছেন জাগাতে।
সাদিকুর রহমান বরগুনা সদর উপজেলার বাশবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা। গত ২২ ডিসেম্বর তিনি ইতালি থেকে দেশে ফিরেন এবং ২৩ ডিসেম্বর স্ত্রী ফারজানা (২৯) ও শ্যালক সুফিয়ানের (২৫) সঙ্গে বরগুনার উদ্দেশ্যে অভিযান ১০ লঞ্চে ওঠেন।
কথা হলে সাদিকুর রহমান জানান, আগুন লাগার বিষয়টি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে আসেন এবং আশপাশের কেবিনের ঘুমন্ত যাত্রীদের জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। অনেক ডাকাডাকি করে বেশ কিছু কেবিন থেকে যাত্রীদের বের করেন। তার পাশের কেবিনে ছিলেন পাথরঘাটার ইউএনও। তাকেসহ চারটি কেবিনের যাত্রীদের ডেকে তোলেন।
এছাড়া যতগুলো সম্ভব হয়েছে কেবিনে ধাক্কা দিয়ে যাত্রীদের সজাগ করে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য বলেছেন। পরে আগুনের পরিমাণ বাড়তে দেখে প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সাধারণ মানুষের সাহায্য চেয়ে তিনি ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন। আগুনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে একপর্যায়ে তিনি স্ত্রী ও শ্যালককে নিয়ে লঞ্চ থেকে তীরে লাফিয়ে পড়েন এবং আগুন নেভাতে সাহায্য চেয়ে ফেসবুক লাইভ চালিয়ে যান।
সাদিকুর রহমান বলেন, আমি সজাগ ছিলাম। ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের ঠিক আগে গাবখান সেতুর কিছু আগে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগে। ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো লঞ্চেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চ থেকে আমাদের নামার ৩০-৪০ সেকেন্ড পরেই লঞ্চটি জোয়ারে নদীর গভীরে ভেসে যায়। এরপর যে যেভাবে পেরেছে বাঁচার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই তীরে উঠতে পারেননি।
তিনি বলেন, শুরু থেকেই লঞ্চটির অস্বাভাবিক গতি ছিলো। আগুন লাগার সাথে সাথে ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো। এছাড়া লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপণ, লাইফ জ্যাকেট সংকট ছিলো। তাই হতাহতের ঘটনা বেশি হয়েছে। বরগুনায় দীর্ঘ দিন ধরে লঞ্চ সিন্ডিকেট চলে আসছে। সিন্ডিকেটের কারণে এমকে শিপিং লাইন কোম্পানি ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির লঞ্চ এখানে চলতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে একতরফা অকেজো ফিটনেসবিহীন লঞ্চেই আমাদের বাধ্য হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এখন সময় এসেছে এসব সিন্ডিকেট বন্ধ করার। নয়তো ভবিষ্যতে আরও কোনো বিপদ ঘটতে পারে।
ইতালিপ্রবাসী যাত্রী সাদিকুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে রাতে ঘুম আসে না। সারাক্ষণ চোখের সামনে সেদিনের সেই ভয়াবহ দৃশ্য ভাসতে দেখি। মনে হয় নিজের শরীর থেকে এখনো পোড়া গন্ধ আসছে। মানুষের বাঁচার আকুতি আর আগুনে পুড়ে যাওয়া দৃশ্য দেখার পর থেকে জীবনযাপন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি এমন ভয়াবহ ঘটনা আর যেন কোথাও না ঘটে।
প্রসঙ্গত, ২৩ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী অতিক্রমকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের বরগুনা সদরের পোটকাখালী গ্রামে খাকদোন নদীর তীরবর্তী গণকবরে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় বরগুনা, ঝালকাঠি ও ঢাকায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় লঞ্চের মালিকসহ পাঁচজন কারাগারে রয়েছেন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এমএসআর