একাত্তরের স্মৃতিময় দিনগুলো আজও কাঁদায়
‘হঠাৎ করে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। চারপাশের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হয়ে শাখারীবাজারের দিকে গেলাম। বাড়িতে বাড়িতে লাশ পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেল। এমন দৃশ্য কোনদিনও দেখিনি। চোখ বেয়ে তখন অশ্রু ঝড়ছিল। শুনলাম দেশের পরিস্থিতি ভালো না। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু করেছে। সারাদেশে আগুন জ্বলছে আর মানুষ মরছে। এসব শুনে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি।’
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অংশগ্রহণের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিমাখা এসব কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সামছুল হক। দেশের মানুষকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে নিজের জীবনবাজি রেখে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ানো সেই স্মৃতিময় দিনগুলো সামছুল হককে আজও কাঁদায়।
ঢাকা পোস্টকে লোমহর্ষক সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সামছুল হক। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ জলিল।
বরিশাল, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জের পুরোটা আর খুলনা-ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় ৯ নম্বর সেক্টর। নদীবেষ্টিত এ সেক্টরটি ৩টি সাব-সেক্টরে ভাগ ছিল। শুরুতে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা তাকিতে এর হেডকোয়ার্টার থাকলেও পরে সরিয়ে নেওয়া হয় হাসনাবাদে।
যুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের পরপরই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল উল্লেখ করে সামছুল হক বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল। এরপর দিন থেকেই বাঙালিরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। তখন যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী জনতা। অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসন, হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের খতমে যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা প্রাণপণ লড়েছি।
পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে এক খণ্ড স্বাধীন ভূখণ্ডের আশায় অচেনা পথে পা বাড়িয়েছিলেন সামছুল হক। তখন তার বয়স ২৬ ছুঁইছুঁই। টগবগে তারুণ্যে উজ্জীবিত সামছুল যুদ্ধ চলাকালে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেখানে ছাত্র ইউনিয়ন রাজনীতির অনুপ্রেরণা আর বঙ্গবন্ধুর সাহসী দিকনির্দেশনায় তিনি যুদ্ধে যেতে মনস্থির করেছিলেন।
ঢাকা পোস্টকে সামছুল হক বলেন, আমি তখন জগন্নাথ কলেজে পড়াশোনা করতাম। ছাত্র ইউনিয়নের এম এ মান্নান, উনি লক্ষ্মীবাজারের তখনকার স্থানীয় নেতা ছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। আরেকজন ছিলেন সামাদ ভাই, উনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। তাদের কাছ থেকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারতাম।
২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রির কথা মনে পড়লে চোখে ক্ষতবিক্ষত লাশের দৃশ্য ভেসে ওঠে। সেই রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব যারা দেখেনি, তাদের কোনোভাবেই হৃদয়বিদারক এ যুদ্ধ বোঝানো যাবে না। এভাবেই কথাগুলো বলতে বলতে কিছু সময় নীরব থাকেন সামছুল হক।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা তুলে তিনি বললেন, ইসলামপুর ফাঁড়িতে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে গেল। স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে জানলাম সেখানে কেউ নাই। শাখারীবাজারে গিয়ে দেখলাম বাড়িতে বাড়িতে লাশ পড়ে আছে। অনেকগুলো ক্ষত-বিক্ষত লাশ, মাটিতে রক্তের কালচে জমাট।
আমি যে বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতাম, তাদের কাছে গেলাম। দেশের পরিস্থিতি ভালো না জেনে তারা থাকতে দেয়নি। সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাদ ভাইয়ের মুন্সিগঞ্জের বাড়িতে যাওয়ার জন্য হঠাৎ করেই রওনা করলাম। সেখানে যাওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গা নদী পাড় হওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়লাম।
ছন্নছাড়া হয়ে অনেক কষ্টে মুন্সিগঞ্জে পৌঁছে যাই। ২ দিন পরে সেখান থেকে পিরোজপুরের কলাখালীতে আসার জন্য ছোট লঞ্চে উঠলাম। অনেক তল্লাশির মধ্যে রওনা দিলাম। শুনলাম পিরোজপুর দখল করতে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পনা করছে।
তিনি আরও বলেন, খুব চিন্তায় পড়লাম। সদরে না গিয়ে বরিশাল থেকে কলাখালীর দিকে গেলাম। নৌকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে ভাগ্যকূল নামে এক জায়গার আম বাগানে উঠে সেখানেও গোলাগুলির মুখে পড়লাম। সেখানকার একটি সবজিখেতের মধ্যে দিয়ে পাড় হতে গিয়ে হাত পা থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে। পরে নিজ বুদ্ধিতে নৌকায় উঠে অজানা পথে চলতে গিয়ে যশোরের ভদ্রপাড়ায় এক বাড়িতে পৌঁছলাম। সেখান থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে প্রথমে ভারতের পিপা ক্যাম্পে যাই।
কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং
ভারতের পিপা ক্যাম্প থেকে পরিচয় গোপন রেখে নকশাল এলাকায় চলে যান সামছুল হক। যাওয়ার আগে তার পূর্বপরিচিত একজনের
সহযোগিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখান। পরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বিহারের চাকুলিয়ায় চলে যান। সেখানকার চাকুলিয়ার ফাঁসির মঞ্চের সামনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন সামছুল হক।
তিনি বলেন, চাকুলিয়ার ট্রেনিং শেষ করে বীরভূমে যাই। সেখানে গিয়েও ট্রেনিং নিতে হয়েছে। এ সময় মেজর জলিলের সাথে পরিচয় হয়। মেজর জলিল ও মেজর জিয়া উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র নিতে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে লুট করা চাল নিয়ে ভারতে যান। পূর্বপরিচিত হওয়ায় তারা আমাকে তাদের সঙ্গে নিলেন। রাতেই নৌকা নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
রণাঙ্গনে সামছুল হকের স্মৃতি
ভারত থেকে নদীপথে নৌকায় করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতেই পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়েন সামছুল হক। আত্মরক্ষার্থে একটি জঙ্গল হয়ে সুন্দরবনে ঢুকে পড়েন। পরে সেখান থেকে মেজর জিয়া উদ্দিনের নির্দেশে ছোট ছোট গেরিলা বাহিনী তৈরি করা হয়। একটি দল নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন পিরোজপুরে রওনা দেন।
ঢাকা পোস্টকে সামছুল হক বলেন, বাগেরহাটের রায়েন্দা এলাকায় গোলাগুলি চলছিল। এ কারণে আমরা পিরোজপুরে পাড়েরহাট হয়ে ঢুকে পড়ি। নদীপথে আসার সময়ে রাজাকার ও পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে বাগেরহাট এলাকার যুদ্ধ হয়। সবাইকে খতম করার পরে আমার নেতৃত্বে পাড়েরহাটে গিয়ে পৌঁছি। পিরোজপুরে আসার পথে রাজাকার বাহিনীর হামলার মুখে পড়ি।
তাদের প্রতিহত করে তদের নেতাসহ ৪ জনকে ধরে নিয়ে আসলাম। প্রায় ২০০ লোক নিয়ে নভেম্বরে পিরোজপুর আক্রমণ করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকি। কাউখালী ও বাগেরহাট থেকে আরও দুটি দল পিরোজপুরে আসছিল। আমাদের আক্রমণের খবর পেয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা পিরোজপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়, যোগ করেন তিনি।
জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত ৯ নম্বর সেক্টরে পাকিস্তানি হানাদারদের লক্ষ্য করে অসংখ্য গেরিলা আক্রমণ চালানো হয়। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে বরিশালে অভিযান চালায় গেরিলা বাহিনী।
পটুয়াখালীর একটি স্থায়ী ঘাঁটি থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম। অন্যদিকে সুন্দরবন এলাকায় লেফটেনেন্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে আক্রমণ চালায় আরেকটি মুক্তিযোদ্ধার দল। সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত বাহিনী ছিল ক্যাপ্টেন নুরূল হুদার নেতৃত্বে। প্রায় ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রাণপণ লড়েছেন এ সেক্টরে।
নদীবেষ্টিত হওয়ায় এ সেক্টরটিতে বেশ সফলতা পায় জলযোদ্ধা ফ্রগম্যানরা। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে মোংলা ও চালনা বন্দরে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক নৌবাহিনীর ওপর চালানো হয় হামলা। অসংখ্য খণ্ড খণ্ড সশস্ত্র আক্রমণ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে।
রাজাকার ভেবে আটক
যুদ্ধচলাকালীন ভারত সীমান্ত পারাপারে সময়ে কিছু শরণার্থীদের ভুলে বেকায়দায় পড়েছিলেন সামছুল হক ও তার সহযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মন্টু। তাদের দুজনকে রাজাকার ভেবে আটক করা হয়েছিল। সেই স্মৃতি ভেসে উঠলে চোখের সামনে মুজিবুর রহমান মন্টুকেও খুঁজে পান সামছুল হক।
সামছুল হক বলেন, কলকাতার এক থানায় আমাদের দুজনকে একবার ধরে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ছাড়া যখন বনগা বর্ডারে ঢুকি তখন আবার বেকায়দায় পড়লাম। এবার কিছু শরণার্থী আমাদের রাজাকার সন্দেহে ধরিয়ে দিল। সেখানে আমরা জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাদের পিরোজপুর থেকে আসার কথা জানালাম।
এরপর তৎকালীন মন্ত্রী ক্ষিতিশ মণ্ডলের পরিচয় দেওয়ায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কালিপদ মোক্তার আমাদের উদ্ধার করে হাসনাবাদে যাওয়ার জন্য ট্রেনে তুলে দিলেন। আমরা একসঙ্গে ১৮ জন ছিলাম। ৪ জন মেডিকেল কোরে বাদ পড়ল। মেজর জিয়া উদ্দিনের সঙ্গে ও মেজর জলিলের সাহায্যে আমরা সবশেষ ১৪ জন দেশে ফিরে আসি।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা
মুক্তিযুদ্ধ ও নিজের স্বপ্ন নিয়ে অ্যাডভোকেট সামছুল হক বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছিল মানুষ যেন না খেয়ে না থাকেন। মানুষের ওপর কারো কোনো অন্যায় অবিচার থাকবে না। আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি এনে একটা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি। এ কারণে নিজের স্বার্থকে আত্মাহুতি দিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোনো স্বীকৃতি ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যার নেতৃত্বের সরকার আমাদের যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে। আমি সন্তুষ্ট হলেও হতাশ হই যখন অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিন দিন লম্বা হতে দেখি। আমাদের দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অল্প কিছু মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাইনি। এখন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যা হচ্ছে, সবই ব্যবসা।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এ জেলার অগণিত মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পিরোজপুর ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। স্বাধীনতার পরে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে জেলায় ২ হাজার ৭০০ বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।
সামছুল হক ১৯৬৯ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৃত মমিন উদ্দিন খান, মা মৃত সালেহা বেগম। মা-বাবার সংসারে ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সামছুল হক ছিলেন ৬ষ্ঠ। বর্তমানে বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রী ও ১ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। তিনি বর্তমানে পিরোজপুর শহরের সিআইপাড়া এলাকায় বসবাস করছেন।
এমএসআর