আশপাশে সবাই শহীদ হলো, বেঁচে রইলাম আমি
১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তখন শেরপুরে প্রতিটি অফিস, আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আইয়ুব খানের ছবি টানানো বাধ্য ছিল। সে সময় আমরা সব অফিস-আদালত থেকে আইয়ুব খানের ছবি নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিই। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান— সবকিছুর সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবর রহমান ইপিআরের ওয়্যারলেস ব্যবহার করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর আমি ময়মনসিংহ থেকে শেরপুর জেলা শহরে ফিরে আসি। তখন শেরপুর পৌর শহর ছিল হিন্দুপ্রধান এলাকা। ঢাকা থেকে আমাদের কাছে নির্দেশ এল হিন্দুদের জানমালসহ বাড়িঘর রক্ষা করতে হবে। নির্দেশমতো আমরা স্থানীয় কয়েকজন যুবক মিলে লাঠিসোঁটা নিয়ে হিন্দুদের বাড়ি পাহারা দিতে শুরু করি। তখন অস্ত্র বলতে পরিচিত ছিল হকিস্টিক ও চাকু। দু-এক দিন পর ঢাকা থেকে আবার নির্দেশ এল শেরপুরের সব হিন্দু পরিবারকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত পৌঁছে দিতে। সেদিন ছিল ২৮ মার্চ আমরা দুটি বাসে করে সব হিন্দুকে নিয়ে শেরপুর শহর থেকে ভারত সীমান্তের দিকে রওনা হই।
নিরাপত্তার জন্য আমাকে একটি রাইফেল দেওয়া হয়েছিল। পথিমধ্যে শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের বাজিতখিলা বাজারে রাজাকার-আলবদররা আমাদের বাস আটক করে। তখন আমি রাইফেল দিয়ে একটি ফাঁকা গুলি ছুড়ি। ভয়ে রাজাকার-আলবদররা রাস্তা থেকে সরে যায়। এরপর দুটি বাসের সকল হিন্দু পরিবারের সদস্যদের আমরা শেরপুরের নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে ভারত পাঠিয়ে দেই।
শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম হিরো স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা তুলে ধরেন ঢাকা পোস্টের কাছে। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে তার স্মৃতিচারণা।
যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা
নূরুল ইসলাম বলেন, ২৫ এপ্রিল বাড়ি ফিরে মাকে জানাই আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করব। মা আমাকে একটি দেড় ভরি ওজনের চেইন গলায় পরিয়ে দেন। যেখানে সুন্দর একটি লকেটে বড় করে আমার নাম 'হিরো' নাম লেখা ছিল। এরপর মা তার আঁচল থেকে ২০০ টাকা বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, আমার দোয়া সব সময় তোর সঙ্গে থাকবে।
যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ
২৬ এপ্রিল নূরুলরা কয়েকজন শেরপুর জেলা শহর ত্যাগ করেন। ওই দিন শেরপুরের ভারত সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া হয়ে হালচাডি গ্রামে চলে যান তারা। সেখান থেকে নাকুগাঁও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের ঢালু শহরের বারাঙ্গাপাড়ায় যান প্রশিক্ষণের জন্য।
এই বীর বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় বিএসএফের কাছে যুদ্ধের অনুশীলন করা। আমরা যাওয়ার এক দিন আগে সেই ক্যাম্পে পাকিস্তানি বাহিনী পেছন থেকে আক্রমণ করে ব্রাশফায়ার করে। সে ঘটনায় ওই ক্যাম্পের সব বিএসএফ জওয়ান মারা গেলেও একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তার নাম ছিল ক্যাপ্টেন বাজিত সিং।
১ জুন আমরা ভারতের তুরায় চলে যাই। সেখানে বাইপাইল নামক স্থানে দীর্ঘ এক মাস যুদ্ধের সব অনুশীলন সমাপ্ত করি। সেখানকার সেনাবাহিনীর নায়েক ওস্তাদ পলাশ ও সুবেদার জার সিং যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ করান। ওই ট্রেনিংয়ে আমাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এসএমসি, এসএমজি, এসএলআর, এলএমজি, রকেট লাঞ্চার, টু ইন মর্টার এবং ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড চালানোর কৌশল ও নিয়ম কানুন শেখানো হয়। জুনের শেষ দিকে আমরা মোট সাতজন বাংলাদেশি ছিলাম।
বাংলাদেশে যুদ্ধক্ষেত্র
১ জুলাই ভারত থেকে ফিরে আসেন নুরুল ইসলাম। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও প্রবেশ করেন। তারপর সহযোদ্ধাদের নিয়ে শুরু করেন যুদ্ধ। তিনি বলেন, নাকুগাঁও তখন একটি মাত্র কাঁচা রাস্তা। খালের দুপাশে দুটি খাল ছিল। সেই খাল দুটি দিয়ে প্রায়ই অসংখ্য লাশ ভেসে যেত। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে সেই রাস্তাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ হতো।
রোমহর্ষক স্মৃতিচারণা
এক দিন রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলছিল। পাকিস্তানিরা বারবার টুইন মর্টার শেল ব্যবহার করছে। এটা ব্যবহার করলে চারদিক আলোকিত হয়ে যেত। সেই আলো ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারত। সেদিন আমরা তিনজন ছিলাম। যুদ্ধ চলছে তাদের সঙ্গে। হঠাৎ আমাদের দুজনের গুলি শেষ হয়ে যায়। এরপর আমি টানা ফায়ার করতে থাকি। অবশেষে তারাও পেছনে সরে যায়, আমরাও ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাই।
তিনি বলেন, পরে ২৮ জুলাই আমরা হালুয়াঘাটের দিকে রওনা হই। ওই দিনই আমরা হালুয়াঘাটের নাগলা ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিই। যেন ওই ব্রিজ ব্যবহার করেই পাকিস্তানি বাহিনীরা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট হয়ে নাকুগাঁও দিয়ে শেরপুর জেলায় প্রবেশ করতে না পারে।
৭ আগস্ট আমরা হালুয়াঘাটে অবস্থান করি। আজিজের নেতৃত্বে সেদিন যুদ্ধের ছক কষা হয়। টার্গেট বান্দরঘাটা ক্যাম্প আক্রমণ করা। তুমুল গোলাগুলি শুরু হলো। এমন সময় একটি ব্রাশফায়ার মুক্তিযোদ্ধা আবুলের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। সে তাৎক্ষণিক সেখানে শহীদ হয়।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলে। পরদিন ৮ আগস্ট আবারও যুদ্ধ শুরু হলো। আমরা নিরাপদ জায়গা থেকে গুলি ছুড়ছি। হঠাৎ আমার পাশে থাকা পরিমল দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক সে সময় একটি বুলেট তার মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। সে শহীদ হলো। আশপাশে সবাই শহীদ হলো, অলৌকিকভাবে বেঁচে রইলাম আমি।
বীরের বেশে বিজয় লাভ
রণাঙ্গনের এই সেনানী বলেন, একে একে নকলা, নালিতাবাড়ী এবং ৭ ডিসেম্বর শেরপুর সদর শত্রুমুক্ত হয়। নালিতাবাড়ী হয়ে আমরা যখন নকলা উপজেলায় আসি। তখন সেখানে শ-খানেক রাজাকার আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে বহ্মপুত্র নদী পার হয়ে জামালপুরের পিয়ারপুরে চলে যাই।
১০ ডিসেম্বর পিয়ারপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখি কিছু মানুষ একটি কক্ষকে উদ্দেশ করে ঢিল ছুড়ছে। এরপর আমরা জানতে পারি সেই কক্ষে দুজন পাকিস্তানি লুকিয়ে আছে। আমরা তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল। কক্ষ লক্ষ্য করে দু-চারটা গুলি ছুড়লাম। তবু কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরে আমিনুল নামে একজন আমার কাছে থেকে দুটি হ্যান্ডগ্রেনেড নিয়ে চার্জ করে। এতে দুই পাকিস্তানি মারা যায়।
তিনি বলেন, জামালপুর থেকে আমরা ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার শেরেবাংলা নগরে (আগারগাঁও) আসি। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমরা বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে উঠি।
বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাধারণ জনগণ আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। নিজের মায়ের পেটের ভাইদের মতো খাতির-যত্ন করেছে। কেউ থাকতে দিয়েছে, কেউবা দুবেলা খেতেও দিয়েছে। আজ দেশ স্বাধীন। তবে তাদের অবদানের কথা আমরা ভুলব না। এই করোনাকালীন প্রায় ৪০ জন সহযোদ্ধা বিভিন্ন অসুখে মারা গেছেন। এখনো ৩টি আবেদন আমাদের কাছে জমা আছে। সময় পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না।
তবে স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের কিছু আক্ষেপ আছে। যেমন প্রতিটি জেলায় সরকারি অর্থায়নে অনেক প্রতিষ্ঠান, ব্রিজ, রাস্তা নির্মিত হয়। কিন্তু কোনোটিতে শহীদ বা জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হয়নি। যদিও শ্রীবরদি উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ব্রিজ ও শেরপুর জেলা শহরের একটি রাস্তা শহীদ বুলবুলের নামে হয়েছিল।
শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জিন্নত আলী বলেন, ১৯৭১ সালে রাজাকাররা আমার ভাইকে অপমান করেছিল। মূলত সেই অপমানের জবাব দিতেই যুদ্ধে অংশগ্রহন করি। সেই লম্বা ইতিহাস এখন আর বলতে চাই না। এখন এই বুড়ো বয়সে আমাদের কিছু দাবি দাওয়া আছে যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাতে চাই।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০০ টাকা ভাতার প্রচলন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণে এখন আমরা ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা পাই। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যে ভাতা পায়, সেটা দিয়ে সংসারের খরচ মেটানোর কষ্টকর। যদি ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার আমাদের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করত, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসের টাকা ভাতা থেকে কেটে রাখতে পারবে। এক সময় মুক্তিযোদ্ধার কবরের জন্য ২ লাখ, বাড়ির জন্য ৮ লাখ ভাতা দিত। তাই সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়।
উল্লেখ্যে, মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন ৮৪ জন বীর সন্তান। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানিরা। সেদিন নারী, পুরুষ, শিশুসহ ১৮৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
এনএ