কাঁদছিলেন মা, বাবারও চোখ দিয়ে ঝরছিল পানি
‘বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। চারিদিকে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজছে। আহ্বান জানানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর থেকেই রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠল। ভাবলাম বাড়িতে বসে থাকার আর সময় নেই। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। স্বাধীন করতে হবে প্রিয় মাতৃভূমিকে।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে অন্তত ১০টি সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণকারী মাগুরার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী শহিদুল ইসলাম। তিনি শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের মৃত চাঁদ আলীর ছেলে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যখন মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় চাই, তখন এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। পাশে বাবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
‘মা বললেন, বাবা পাকিস্তান বাহিনীর সেনারা তোরে মারে ফেলবেনে। আমরা কী নিয়ে বাঁচব?’ উত্তরে বললাম, ‘তোমাদের সম্মান রক্ষার্থে এই প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে হবে, এই দেশকে শত্রু ও হানাদারমুক্ত করতে হবে। আমাকে যুদ্ধে যেতেই হবে।’ সেদিন অনেক কষ্টে মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
অনুপ্রেরণা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রীপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকবর হোসেন মিয়া উদ্যোগী হয়ে প্রায় ৬০০ যুবককে নিয়ে নিজের নামে গড়ে তোলেন বিশাল মুক্তিবাহিনী। যা আকবর বাহিনী এবং দেশ স্বাধীনের পর শ্রীপুর বাহিনীর নামে স্বীকৃতি পায়। শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার অনুপ্রেরণায় আমি একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আকবর বাহিনীতে অংশগ্রহণ করি।
মাগুরা, শ্রীপুর, বালিয়াকান্দি, শৈলকুপা, পাংশা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ অর্থাৎ ঝিনাইদহে গাড়াগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা আমাদের দখলে ছিল। এখানে মুক্তিসেনারা সগর্বে বীরত্বের সঙ্গে চলাফেরা করতো। আমরাই এ অঞ্চল শাসন করতাম। পাকিস্তান সেনারা আমাদের ভয়েই এসব এলাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালাতে থাকে। এ অঞ্চলে ছিল আমাদের সার্বভৌমত্ব রাজত্ব।
কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং
শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি প্রথমে শ্রীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে আকবর বাহিনীর অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্পে একজন সদস্য হিসেবে যোগদান করি। এখানে অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়া আমাদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন। এরপর আমাদের টুপি পরা গ্রামের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে আমাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। তবে অস্ত্র কম থাকায় আমাদের ২৫/৩০ জন যুবককে তিনি ভারতে পাঠালেন।
ভারতের রানাঘাট ক্যাম্পে আমরা সাক্ষাৎ করি ক্যাম্প ইনচার্জ তৎকালীন এমপি আছাদুজ্জামানের সঙ্গে। কিছুদিন রানাঘাট ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর আমাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হলো চাকুলিয়া ক্যাম্পে। সেখানে আমাদের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
গেরিলা প্রশিক্ষণের সাথে সাথে কীভাবে শত্রু বাহিনীকে আক্রমণ করে সেভ জোনে ফিরে আসা যায়, সেসবের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম ভারতের ওই ক্যাম্প থেকে। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়া হয়। এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে আমরা আবার দেশে নিজ এলাকায় ফিরে আসি, যোগ করেন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্র ও সেক্টর
ভারতের ট্রেনিং শেষে আমরা ৮ নম্বর সেক্টরে পুনরায় আকবর বাহিনীর সদস্য হিসেবে যোগদান করি। সেখানে আমাদের তৎকালীন ৮ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) এটিএম আব্দুল ওয়াহ্হাব আমাদের প্রশিক্ষণ এবং দিক নির্দেশনা দিতেন। আমরা আকবর বাহিনী তথা শ্রীপুর বাহিনীর সদস্যরা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ১৫ থেকে ১৭ টি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তাতে প্রায় ২০০ পাকসেনা নিহত হয়। আমরাও কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি।
মুক্তিযোদ্ধা কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা শ্রীপুর থানা তিনবার এবং শৈলকুপা থানা একবার দখল নিয়ে সমস্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে চলে আসি। শুধু শৈলকুপা থানা আক্রমণ করে সেখান থেকে ৫৭টি আগ্নেয়াস্ত্র আমরা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলাম। সর্বোপরি আমাদের বাহিনীতে দুই হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, যা দিয়ে আমরা আমাদের এসব অঞ্চল থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করি।
রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতি
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ঝিনাইদহের শৈলকুপার আলফাপুর, মাগুরার শ্রীপুরের বরিশাট, হাজিপুর, মাশালিয়া, খামারপাড়া, কাজলি খেয়াঘাট, নাকোল এবং গোয়ালপাড়া রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে পাকহানাদার বাহিনীর জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হই। অনেক পাকসেনার মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি, তাদের অনেকে আহত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে হানাদার বাহিনীর আধুনিক সাঁজোয়া গাড়ি পাঙচার হয়ে যায়, যা তারা ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর আনসার ক্যাম্পে ৮ অক্টোবর রাজাকার ও পাকসেনাদের উপর আমরা তীব্র আঘাত হেনেছিলাম। সেখানে অনেক রাজাকার ও তাদের দোসররা আহত হয়েছিল। তবে দুঃখের বিষয় বিনোদপুরের যুদ্ধে আমাদের সহযোদ্ধা জহুরুল আলম মুকুল গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে শাহাদাত বরণ করেন। তাই আমরা ৮ অক্টোবর শহীদ মুকুল দিবস হিসেবে পালন করি।
একাত্তর সালের ২৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সব থেকে বিয়োগান্তক ঘটনা উল্লেখ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যেসব মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকুপা অঞ্চলের দায়িত্ব ছিলেন, তারা শৈলোকুপার কামান্না গ্রামের মাধবচন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। রাজাকাররা পাক বাহিনীকে গোপনে সে খবর পৌঁছে দেয়। এরপর ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে পাক হানাদার বাহিনী সেই বাড়িটি ঘিরে ফেলে ব্রাশফায়ার করে।
সেখান থেকে কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলেও পাকবাহিনীর সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্রের সামনে টিকে থাকতে পারেনি। সে সময় পাকবাহিনীর গুলিতে সেই বাড়িতে ২৭ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ বিসর্জন করেন। তাদের মধ্যে ২৫ জনের বাড়ি আমাদের মাগুরার বিভিন্ন এলাকায়। ১৫-১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এখান থেকে প্রাণে বেঁচে যান। শাহাদত বরণ করা এই ২৭ জনই আকবর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্রতি বছর ২৬ নভেম্বর কামান্না দিবস পালন করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম বলেন, একসঙ্গে যারা সেদিন যুদ্ধ করেছিলাম তাদের অনেকেই পরলোকে গমন করেছেন। তাদের মধ্যে আব্দুল মমিন উদ্দিন, কাদের বিশ্বাস, নিখিল দত্ত, আব্দুর রাজ্জাক, জনি আলম মুকুল অন্যতম। যারা বেঁচে আছেন তাদের আবু বকর, কাউসার, তুর্কি সড় অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন।
রনাঙ্গণে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা
আকবর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক দল গঠন করে বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাতেন যুদ্ধের জন্য। সে সময় আমরা বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছি। প্রত্যেকেই আমাদের যথাসাধ্য খাবার-দাবার যোগান দিয়েছেন। অনেক মা-বোনদের কাছ থেকেও আমরা সহযোগিতা পেয়েছি। মোটকথা সাধারণ মানুষ মুক্তিকামী ছিল বলেই আমরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে যুদ্ধ করতে পেরেছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তি স্বীকার
মুক্তিযোদ্ধা কাজী শহিদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমাদের অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা অনেক ভালো আছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। যাদের ঘর নেই, তাদের থাকার ঘর করে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা ভালো ভালো চাকরি পাচ্ছে। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার ভাতার ব্যবস্থা করেছে। আমরা এখন মাসে কুড়ি হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছি।
মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোল্লা নবুয়ত আলী বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে আছেন। নবুয়ত আলী আকবর বাহিনী তথা শ্রীপুর বাহিনীর সহ-অধিনায়ক ছিলেন। আকবর হোসেন মিয়ার সাথে থেকে তিনি এসব অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। নবুয়ত আলী তৃতীয়বারের মতো জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্বে রয়েছেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ অভিযানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনী থেকে অনেক সদস্য আমাদের বাহিনীতে এসে যোগদান করেন। মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যেই আমাদের বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দুই সহস্রাধিক ছাড়িয়ে যায়। তবে আমরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিলাম।
শুধু বাংলাদেশ বেতার থেকে নয়, বিবিসি এবং ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে আমাদের শ্রীপুর বাহিনীর গৌরবগাথা অভিযানের কথা নিয়মিত প্রচার করা হতো।
পাকিস্তান বাহিনীর সাথে আমাদের কয়েকটি রোমহর্ষক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল। শ্রীপুর বাহিনী শ্রীপুর অঞ্চলে গড়ে উঠলেও এই বাহিনীর সদস্যরা মাগুরা অঞ্চল ছাড়াও, ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়।
নবুয়ত আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কিছু চাওয়া লাগেনি। তিনি স্বেচ্ছায় যা দিয়েছেন তা অনেক। তবে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা যে আদর্শ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম এমন একটি দেশ গড়ব যেখানে থাকবে না কোনো ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচার। কিন্তু সেটা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
মাগুরা জেলার ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসএম আব্দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাগুরায় ১ হাজার ৯৯২ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, সবাই ভাতাভোগী। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য যারা অনলাইনে আবেদন করেছিলেন, সেটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এমএসআর