পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে
বয়স তখন ১৭ কি ১৮ বছর। টগবগে এ যুবক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ও ভগ্নিপতির (আমির আলী) উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ব হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। বাবা-মা মেনে নেবেন না বা তাদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে, তাই সবার অলক্ষ্যেই বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। রওনা দেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে। ভারতের নদীয়া জেলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য আব্দুল লতিফ নামের এক হাবিলদারের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় যান। সেখানে ১ মাস ৫ দিন ধরে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে শিকারপুর ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টরে ফিরে আসেন তিনি। তৎকালীন তৌফিক ই-ইলাহী সাহেবের অধীনে নিজ নামে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে নেমে পড়েন দেশ-মাটি-মানুষকে রক্ষার মহান দায়িত্বে।
দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে জীবন বাজি রেখে যেসব মহান যোদ্ধা অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, তাদের অন্যতম একজন গোলাম হোসেন। তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম কাজিপুরের মৃত সাকেম উদ্দীনের ছেলে।
ঢাকা পোস্টকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিমাখা কথাগুলো জানিয়েছেন গোলাম হোসেন। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে ঢাকা পোস্টের নিয়মিত আয়োজনে আজ থাকছে এই গেরিলা যোদ্ধার জীবনকাহিনি।
গোলাম হোসেন বলেন, অস্ত্র সরবরাহের পর তৌফিক-ই-ইলাহীর আদেশে বাংলাদেশের বামন্দী পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পকে টার্গেট করে পাঠানো হয়। সেখানে মাসখানেক যুদ্ধ করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর দল পিছু হটে। পরে হাড়াভাঙ্গা এলাকায় অবস্থান নিই। পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় একটা শরণার্থী শিবিরে আগুন লাগাবে, এ সংবাদ পেয়ে ১০ জন করে একেকটি প্লাটুনে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে সাহেবনগরে অবস্থান করি আমরা। সে সময় গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন বেতবাড়িয়ার গ্রামের হানিফ।
আমরা তিনজন সাহেবনগর মাঠে আসি পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করতে। তখন রাজাকার বাহিনীর গুপ্তচরকে জিজ্ঞাসা করতেই পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে। এ সময় তিনজনই পিছু হটি। পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করলে আমরাও পাল্টা গুলি বর্ষণ করতে থাকি। ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১১ সেনা নিহত হয়। তবে শরণার্থী শিবিরের নারী-পুরুষেরা গুলিতে আহত হন। পরে ব্যানগাড়ির মাঠে আরও একটি যুদ্ধ হয়। সে সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরাও সঙ্গে ছিলেন। হানাদারদের ছোড়া বোমের স্প্লিন্টারে আমিসহ কয়েকজন আহত হন। পরে সহকর্মীরা আমাদের উদ্ধার করে ভারতের চিকিৎসা শিবিরে পাঠিয়ে দেন। আমার ঘাড় ও হাঁটু ক্ষতবিক্ষত হয়। যে ব্যথা আজও পীড়া দেয় আমাকে।
সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক দিয়ে আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। আমরা তখন একটি গর্তে লুকিয়ে পড়ি। ওপরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টির ফোঁটার মতো আকাশ থেকে গুলি ও বোমার স্প্লিন্টার পড়ছে। আমারা আমাদের সহকর্মীদের সাথে কথাও বলতে পারছিলাম না। কারণ আমাদের মুখের লালা শুকিয়ে যাওয়ায় জিব নাড়াচাড়া করতে পারছিলাম না। সেই কথা মনে হলে শরীর শিউরে ওঠে।
এই বীর সৈনিক বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী যখন আমাদের তাড়া করে, সে সময় গ্রামের আবু বকর প্রথম রাইফেলের গুলি ছোড়ে। ও না থাকলে মনে হয় বাঁচতে পারতাম না। আমার অবস্থা দেখে আমার এক সহকর্মী তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে একটি গর্ত থেকে গামছা ভিজিয়ে আমার মুখে চেপে দিয়েছিল। তা ছাড়া হানিফ আশরাফসহ অনেকেরই কথা মনে পড়ে। যারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
স্থানীয়দের সহযোগিতা সম্পর্কে গোলাম হোসেন বলেন, সে সময় সবচেয়ে স্থানীয়দের সহযোগিতা বেশি পেয়েছি। স্থানীয়রা আমাদের পথ চিনিয়ে দিয়েছেন, শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়েছেন, অনেকেই আমাদের মুখ শুকনা দেখে খাবার দিয়েছেন। কেউ বিপদে পড়লে তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব হতো না বলেও জানান তিনি।
বর্তমান বাংলাদেশ ও চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন বলেন, কিছু পাওয়ার আশায় দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে যাইনি। তারপরও সরকার যে সম্মান ও সহযোগিতা আমাদের করেছে, এতেই তুষ্ট আমরা। তবে আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে জানতে বুঝতে হবে। কীভাবে একটি দেশ এল, এটা তাদের উপলব্ধি করতে হবে। মযুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনকার প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে হবে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার মুন্তাজ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি, তখন কিছুর বিনিময়ে যুদ্ধে যাইনি। দেশ স্বাধীনের পরে কিছুর প্রত্যাশা করিনি। একটাই প্রত্যাশা আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করতে পারছি। এ দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছি। তারপরও দীর্ঘদিন এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কদর বোঝেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের যা দিয়েছেন, এরপর আর কিছু চাওয়া নেই। সব মুক্তিযোদ্ধাই এখন ভালো আছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে।
তিনি বলেন, আমাদের মেহেরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের যে কমিটি ছিল, তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন আমলাদের হাতে নেতৃত্ব। দ্রুত সময়ে আবারও নির্বাচন দিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের কমিটি গঠন করার সুযোগ তৈরি করে দেবেন। প্রতিবছরেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করা হয়। আগামী ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর জেলা পাক হানাদারমুক্ত দিবস। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। ওই দিন শহীদদের আত্মদান ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোচিত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর জেলা হানাদারমুক্ত হয়। সে দিনটিও আমরা পালন করে থাকি। সেই সঙ্গে জেলায় যারা এখনো গরিব মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, তাদের আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১০৮১ জন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তাদের মধ্যে মেহেরপুর সদর উপজেলায় ৪৫৪ জন, মুজিবনগর উপজেলায় ১১৮ জন এবং গাংনী উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৫০৯ জন। তাদের সবাই সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত। মেহেরপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ৪০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক জেলা পরিষদের সামনে প্রকাশ করা হয়েছে।
এনএ