বছরে শুধু একটি শাড়ি পাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে
কীর্তনখোলা নদী লাগোয়া হাওলাদার বাড়ি। ঘরের দরজার সামনে এক খণ্ড জায়গাজুড়ে একটি কবর। দেখে মনে হবে একজনকে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ওটি কোনো একজনের কবর নয়, এখানে শুয়ে আছেন আটজন। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বরিশালে প্রথম এই বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেই হাওলাদার বাড়িতে বিত্তবৈভব কিংবা আভিজাত্যের বিপরীতে এখনো রয়েছে দারিদ্র্যের কশাঘাত। কিন্তু এ বাড়ির রয়েছে ঐতিহাসিক আত্মত্যাগ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় আক্রমণ হওয়ার পর নদীতীরবর্তী সম্ভাব্য যেসব স্থানে আক্রমণ হতে পারে, এমন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেন্স (গর্ত) করে রেখেছিলেন। হাওলাদার বাড়ির রিকশাচালক আব্দুস ছত্তার রাঢ়ীর ঘরের সামনে একটি ট্রেন্স ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ঝুনাহার নদীতে বাধার মুখে পড়ে বরিশাল শহরের দিকে না গিয়ে তালতলী নদীতে ঢুকে তিনটি স্থানে নেমে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তার মধ্যে হাওলাদার বাড়ি একটি।
মিলিটারি আসার সংবাদ পেয়ে ছত্তার রাঢ়ী, তার মা, সন্তান, স্ত্রীসহ আশপাশের ৮ থেকে ১০ জন ওই ট্রেন্সে আত্মগোপন করেছিলেন। মিলিটারিরা নদীতীরে নেমে ওই ট্রেন্সটির সন্ধান পেয়ে যায়। ব্রাশফায়ার করে দুই ট্রেন্সের মুখে। ৮ জনই সেখানে নিহত হন। বাকি দুজন আহত হন। তাদের দাফন-কাফনের কোনো সুযোগ ছিল না। শেষে ট্রেন্সেই তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। সেই গণকবরটি দীর্ঘদিন অরক্ষিত ছিল। তবে কয়েক বছর আগে শনাক্ত করে কবরটি বাঁধানো হয়েছে।
আব্দুল মান্নান জানান, মিলিটারিরা প্রথমে তিনটি গানবোট ও একটি লঞ্চযোগে বরিশাল আক্রমণের জন্য রওনা হলেও ঝুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে পড়ে। পরে তারা ঢাকায় জানালে ঢাকা থেকে জঙ্গিবিমানে সৈন্য এসে হামলা চালায়। মিলিটারি চরবাড়িয়া গ্রামে ঢুকে যাকে যেখানে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পিতা, দাদাকেও গুলি করে হত্যা করে মিলিটারিরা। ওই দিন খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৪৭ জনকে হত্যা, ২৫ জনকে মারাত্মক জখম এবং ৬৬টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। এই শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে এবং তাদের স্বজনদের সহায়তার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সরকারকেই উদ্যোগ নিতে দেখিনি।
মুক্তিযুদ্ধে জ্বলন্ত ইতিহাস হাওলাদার বাড়ি। গণকবরে নিহত হন, ফজলে আলী হাওলাদার, আব্দুস ছত্তার রাঢ়ী, মো. আলফোন নেছা, আব্দুল ওহায়েদ হাওলাদার, এসাহাক হাওলাদার, রিজিয়া বেগম, মো. আঞ্জুমান নেছা ও হুমায়ূন রাঢ়ী।
গণকবরটি সংরক্ষণের অভাব আর শহীদের স্বজনদের রাষ্ট্রীয় সহায়তা না পাওয়ার আক্ষেপ কুড়ে মারে প্রতিক্ষণে। বছর ঘুরে ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস দোরগোড়ায় এলে গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদের জন্য যান, কথা বলেন স্বজনদের সঙ্গে। এরপর সারা বছরই থাকেন প্রসঙ্গের বাইরে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শহীদদের স্মরণে দোয়া-মিলাদেরও সামর্থ্য নেই যুদ্ধে স্বজন হারানো স্বজনদের। শহীদদের স্বজনদের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি আর সরকারি আমলাদের আশ্বাসেই কেটে গেছে অর্ধশত বছর। বিপরীতে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকছেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য মানুষগুলোর পরিবার। তাদের এখন দাবি, আর্থিক অনুদান না দিতে পারলেও রাষ্ট্র যেন তাদের শহীদের স্বীকৃতিটুকু দেন। যেন গরিব হলেও গর্ব করে বলতে পারেন তারা শহীদ পরিবারের স্বজন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গণকবরটি অযত্ন-অবহেলায় পর্যুদস্ত অবস্থায় রয়েছে। ডিসেম্বর উপলক্ষে বাড়ির মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। গণকবরের দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে। নামফলক পরিষ্কার করছিলেন শহীদ ওহায়েদ হাওলাদারের আত্মীয় আলাউদ্দিন হাওলাদার।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর হলো অথচ আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে শহীদদের পরিবার কিছুই পায়নি। শহীদ ওহায়েদ হাওলাদারের একজনমাত্র মেয়ে পুতুল। তার জমি নেই, ঘর নেই। সরকারের এমন কোনো দফতর নেই যেখানে যাননি। মানবেতর জীবন যাপন করলেও কোনো সাহায্য পাননি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে শহীদ পরিবারে প্রতি এমন উদাসীনতা সত্যিই দুঃখজনক।
শহীদ ওহায়েদ হাওলাদারের মেয়ে জহুরা বেগম বলেন, আমার বাবা ওই গর্তেই মারা গেছেন। তখন আমার বয়স ছিল দেড় বছর। মায়ের মুখে শুনেছি, আমার চাচা-চাচি আর মা আমাকে নিয়ে অন্যত্র পালিয়েছিলেন বলে আমরা বেঁচে ছিলাম। নয়তো আমরাও বাঁচতাম না। আক্রমণের ৭ দিন পরে এসে গর্তে আমার আব্বার চেহারাও চিনতে পারেনি কেউ। পচে পোকা হয়ে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। শেষে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। যে দুজন বেঁচে উঠেছিলেন তারা মায়ের কাছে বলেছেন, গর্তে গলা পর্যন্ত রক্তে ডুবে গিয়েছিলেন তারা।
ডুকরে কাঁদেন জহুরা। বলেন, যখন বুঝতে শিখেছি, তখন মা আব্বার গল্প করতেন। আমি কাঁদতাম। আমার সমবয়সীরা দেখতাম মা-বাবার কোলে ওঠে। আমি আব্বার কোলে উঠতে পারতাম না। বড় শখ ছিল আব্বার হাতের বিস্কুট খাওয়ার। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। আব্বার কোলে ওঠার খুব ইচ্ছা ছিল।
তিনি বলেন, আমার বাবার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। তার চেহারা কেমন, তা-ও আমি বলতে পারি না। আমার বাবা কেমন ছিলেন, কালো নাকি সুন্দর, সেই চেহারাও আমি জানি না। আমার আব্বার স্মৃতি যেন ধরে রাখতে পারি, এ জন্য অনেকের দুয়ারে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ সেই ব্যবস্থা করেনি।
জহুরা বেগম বলেন, আমি শুনেছি আব্বা মারা যাওয়ার পরে সরকার থেকে কম্বল আর টিন দিয়েছিল। কিন্তু দাদু তা রাখেননি। তিনি বলেছিলেন, আমার ছেলে নেই সেই দুঃখ তো টিন আর কম্বলে ঘুচবে না। তিনি এগুলো ফেরত দিয়েছিলেন। আমি তো এখন চরম অভাবে আছি। আমার স্বামী মারা গেছেন। একটি মাত্র ছেলে চায়ের দোকান দেয়। বাড়ির জমি কীর্তনখোলায় বিলীন হয়ে গেছে।
অসহায়ত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়েছিলাম। কমান্ডার মোখলেছুর রহমান একটি লিখিত দিয়েছিলেন আমার আব্বা মিলিটারির হাতে নিহত হন বলে। তিনি বলেছিলেন, তোর বাবার একটি স্মৃতি দিলাম। আরও বলেছিলেন, শহীদের পরিবারের সন্তান হিসেবে একটি ভাতা করে দেবেন। ইউএনও অফিসে আবেদন করেছিলাম। স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যানের কাছেও আবেদন করেছি। কিন্তু কেউ কোনো সহায়তা করেনি। শুধু তালতলী বাজারে একটি পাঠাগারে আমাদের ডেকে একটি করে শাড়ি দেন। এই বছরে শুধু একটি শাড়ি পাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে। ওটাই পাওয়া। তা ছাড়া আপনাদের মতো (প্রতিবেদক) অনেক সাংবাদিক ফি বছর আসে আর যায় কিন্তু কোনো উপকারে আসে না। আমি ঠিকই না খেয়ে থাকি।
শহীদের স্বজনদের অভাবে থাকতে হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি সরকারে বিবেক। আমাদের কী করার আছে? অনেক মানুষ আছেন যারা যুদ্ধ করেননি, তারাও সরকারি সহায়তা পান। আর আমার পিতা মিলিটারিদের হাতে শহীদ হওয়ার পরও আমি না খেয়ে আছি। আমি যে আমার আব্বার জন্য বছরে একবার মিলাদ পড়াব, তারও সামর্থ্য আমার নেই। আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এখন সরকারি জায়গায় ছাপড়া দিয়ে থাকি। শুনছি যেখানে আছি সেখানে ময়লাখোলা করা হবে। কখন ঠেলা মেরে এই ঘরটাও ভেঙে ফেলে তা বলতে পারছি না।
অভিযোগ করে বলেন, শহীদ স্বজনদের ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনেকে আমার কাছে তিন লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন। কিন্তু আমি নিজেই থাকি না খেয়ে, টাকা দেব কীভাবে? আমি টাকা দিতে পারিনি তাই আমার ভাতাও হয়নি। আমার দাবি, আমাকে একটি ভাতা করে দেওয়া হোক আর আমার বাবাকে শহীদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাদের গণকবরটি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হোক।
শহীদ ওহায়েদ হাওলাদারের নাতি আব্দুল হালিম বলেন, আমার নানা পাকিস্তানি মিলিটারির গুলিতে নিহত হয়েছেন। অথচ যারা মুক্তিযোদ্ধা না, তারাও এ দেশে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পান। এটিই আশ্চর্যের বিষয়। আমি দাবি জানাই, শহীদ ওহায়েদ হাওলাদারসহ ওইখানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাদের প্রতি সরকার এগিয়ে আসুক।
প্রতিবেশী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, চরবাড়িয়ার হাওলাদার বাড়ির গণকবরটির অবস্থা জরাজীর্ণ। এই গণকবর সংরক্ষণের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে, কিন্তু আমি কখনো শুনিনি গণকবরে শহীদদের স্মরণে কেউ দোয়া-মিলাদ পড়িয়েছে। তা ছাড়া তাদের স্বজনরা যে সেই আয়োজন করবেন তার সামর্থ্যও তাদের নেই।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনিরুজ্জামান বলেন, চড়বাড়িয়ার হাওলাদার বাড়ির গণকবরের বিষয়টি আমি জেনেছি। কবরটি সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা করা হবে। আমি সদ্য যোগদান করেছি। আশা করি অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে গণকবরটি সংরক্ষণের পাশাপাশি শহীদদের স্বজনদের সহায়তার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এনএ