সায়েম এখন লাখপতি
আবু সায়েমের নিজের এখন বার্ষিক আয় ১০ লাখের কাছাকাছি। কারণ তিনি ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং বা বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজ করে আয়ের উপায় করেছেন। শুধু নিজে নন, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ে অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তার দেখানো পথে হেঁটে এলাকার এক হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণী সাবলম্বী হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন আয় করছেন।
আবু সায়েম রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের দোলাপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল আউয়ালের ছেলে। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। মা আরজিনা বেগম গৃহিণী। চার বোন ও দুই ভাইয়ের সংসার তাদের। এর মধ্যে সায়েম ভাইবোনদের মধ্যে পরিবারে পঞ্চম।
সায়েমের বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো পরিবারে অভাব নেমে আসে। তখনই কিছু করার ইচ্ছা শুরু হয় তার। তারপর ঝুঁকে পড়েন ইন্টারনেটে। সারাদিন গুগল ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে ঘেঁটে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ধারণা রপ্ত করতে থাকেন।
সায়েমের দাবি, ২০১৬ সালে ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর অভিজ্ঞতাটা খুব ভালো ছিল না। নিভৃত গ্রামে একবুক স্বপ্ন নিয়ে নিজের নামে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। তখন প্রশিক্ষণার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। নেটওয়ার্ক সমস্যা আর প্রশিক্ষণার্থী সংখ্যা কম থাকায় কিছুটা হোঁচট খান সায়েম। তবে হাল ছাড়নেনি। পড়াশোনাসহ ব্যক্তিগত কারণে পরের বছরই শহরে পা রাখেন। দীর্ঘ ছয় বছরের কঠোর পরিশ্রম শেষে এখন তিনি সফল।
রংপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্সে সপ্তম সেমিস্টারে পড়ছেন আবু সায়েম। ২০১৩ সালে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৩১ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০১৫ সালে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পান জিপিএ-৩.৫০। কোনো প্রশিক্ষক ছাড়াই ফ্রিল্যান্সিং রপ্ত করা সায়েমের ইচ্ছা পড়াশোনা শেষ চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নেবেন।
ঢাকা পোস্টকে ফ্রিল্যান্সার আবু সায়েম বলেন, পরিবারে আমরা দুই ভাই ও চার বোন। কিন্তু আমার দায়িত্ব একটু বেশি। পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে এখন মাসে আমার আয় লাখের কাছাকাছি। বছর শেষে প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় করি। এ আয় থেকে পরিবারের দেখভাল ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে বোনের বিয়ে দিয়েছি। গঙ্গাচড়ায় ৫ শতক জমিও কিনেছি।
বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখার আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বেকারত্ব একটা অভিশাপ। আমি চাই এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ফ্রিল্যান্সিং শিখুক। শুধু পড়াশোনা না করে পড়ালেখার সাথে সাথে নিজেরা কিছু করতে চাইলে ফ্রিল্যান্সিং সুবিধা নেওয়া উচিত। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কাজ করতে পারলে বেকারত্ব ঘোচানো সম্ভব।
এখন শহরের পাশাপাশি সায়েম তার নিজের গ্রামের তরুণদের আবারও ফ্রিল্যান্সিং শেখাতে শুরু করেছেন। রংপুর বিভাগীয় নগরীতেও নিজের নামে গড়ে তুলেছেন দুটি ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখান থেকে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন), লিড জেনারেশন, সিপিএ মার্কেটিং, কন্টেন্ট মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংসহ আউটসোর্সিংয়ে বিভিন্ন মাধ্যম সম্পর্কে তরুণ-তরুণীরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
বর্তমানে সায়েম একাডেমিতে অর্ধশত শিক্ষার্থী ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোসিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আর গেল ছয় বছরে তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে কাজ শুরু করেছেন দেড় হাজেরের বেশি তরুণ-তরুণী। যাদের অনেকেই এখন সাবলম্বী।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা ঠাকুরগঞ্জ এলাকার নুর হোসেনের ছেলে রাশেদ খান মিলন। তিনি নীলফামারী সরকারি টেকনিক্যাল অ্যান্ড কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পড়াশোনা শেষে এখন রংপুর শহরে একটি আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি করছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি সায়েম একাডেমিতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন ফ্রিল্যান্সিং করছি। আমার মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
সায়েমের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর সায়রাবাড়ি গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে সামিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ডিপ্লোমায় পড়ছি। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করছি। শহরে থাকা-খাওয়ার পরও মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
কথা হয় রংপুর নগরের কলেজ রোড খামারপাড়া এলাকার রবিউল ইসলামের মেয়ে রাবেয়া বসরি সুমাইয়ার সঙ্গে। তিনিও সায়েম একাডেমি থেকে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী বর্তমানে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকার মতো আয় করছেন।
উদ্যোক্তা আবু সায়েমকে স্বাগত জানিয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অ্যান্ড সায়েন্স বিভাগ। বিভাগের প্রধান ড. মিজানুর রহমান জানান, ছাত্র অবস্থায় যদি কেউ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়, এটি হবে তার জন্য বাড়তি আয়ের পথ। এখন তরুণদের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সিং শিখছে। করোনা-পরবর্তীতে ফ্রিল্যান্সিং বেকার যুবকদের আশার আলো দেখাতে পারে।
এনএ