হাসি ফুটেছে সেই হারুনের মুখে
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট.কমে সংবাদ প্রকাশের পর হারুন উর রশিদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ফর দেম। এখন আবার নতুন করে গড়ে তোলা মুরগির খামারে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী এ যুবক। নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসই এখন বড় পুঁজি বলে মনে করছেন লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করা হারুন।
বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) বিকেলে হারুন উর রশিদকে তার বাড়ির পাশে নবনির্মিত মুরগির খামারটি হস্তান্তর করে উই ফর দেমের স্বেচ্ছাসেবীরা। এ খামারে ৬০০ মুরগির বাচ্চা দিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে হারুনের বদলে যাওয়ার প্রচেষ্টা। এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি ‘লাঠিতে ভর দিয়ে চলছে হারুনের জীবন’ শিরোনামে ভিডিওসহ একটি সংবাদ ঢাকা পোস্ট.কমে প্রকাশিত হয়।
রংপুর নগরের আট নম্বর ওয়ার্ডের সাহেবগঞ্জ সৎবাজার এলাকায় হারুনের বাড়ি। তার বাবা আবদুল আউয়াল বেঁচে নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু মা আনোয়ারা বেগম। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পড়ে ভালো থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে আসছিলেন হারুন উর রশিদ। উদ্দেশ্য মায়ের মুখে একটু হাসি আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা।
জন্মগতভাবে দুই পা বাঁকা হওয়ায় অন্য সবার মতো স্বাভাবিক চলাফেরা একদমই করতে পারেন না হারুন। তাই লাঠির ওপরই তার ভরসা। দুই হাতে লাঠিতে ভর করে এক স্থান থেকে আরেক প্রান্তে চলাফেরা করতে হয় তাকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বিভিন্ন সময়ে নিজে থেকে কিছু করার প্রচেষ্টা ছিল তার। কিন্তু স্বপ্নে গুড়ে বালু পড়ে করোনা মহামারি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে।
সম্প্রতি সংবাদটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ফর দেম এর নজরে পড়ে। এরপর প্রতিবন্ধী হারুন উর রশিদের পরিবারের খোঁজখবর নেন তারা। স্বচ্ছলতার পথ দেখাতে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয় স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটি। নতুন উদ্যমে নতুন আঙ্গিকে দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে হারুনের জন্য উই ফর দেম গড়ে তোলে মুরগির খামার। যার নাম দেওয়া হয়েছে প্রজেক্ট ‘সূর্যোদয়-১০১’।
উই ফর দেম এর প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ বলেন, ঢাকা পোস্টের সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পারি প্রতিবন্ধী এই হারুনের কথা। দুই পায়ে জন্মগতভাবে সমস্যা নিয়েও পোল্ট্রির ফার্ম করেছিলেন। করোনা মহামারির শুরুর দিকে ওই খামারটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে আকস্মিক ঝড়ে স্বপ্নময় খামারটি ভেঙে পড়ে। নিরুপায় হয়ে পানের দোকান করেন হারুন। কিন্তু বহুতল ভবন নির্মাণাধীন এলাকায় তার দোকান থাকাতে কর্তৃপক্ষ তা ভেঙে দেন। এরপর থেকে হারুন অসহায় জীবন-যাপন করছে। এই সংবাদটি আমাদের অনেক নাড়া দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সমস্যা ও আগ্রহের কথা শুনি। তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে পোল্ট্রি ফার্ম করার বিষয়টি ওঠে এলে আমরা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে আমরা হারুনকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বড় পরিসরে আগের চেয়ে বেশি মুরগির বাচ্চার যোগান দিয়ে একটি পোল্ট্রি ফার্ম তৈরি করে দিয়েছি।
নতুন খামার পেয়ে উচ্ছ্বসিত হারুন। বাচ্চা মুরগির দেখভালে এখন ব্যস্ত সময় কাটবে তার। সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে আবার সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি। ঢাকা পেস্টের এই প্রতিবেদককে হারুন উর রশিদ বলেন, আপনার মাধ্যমে যে সংবাদটি প্রকাশ হয়েছে, এতে করে আমি নিজেই অবাক। দেরিতে হলেও আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। উই ফর দেম আমাকে যে সহযোগিতা করেছে, আমি অনেক খুশি। আমার বিশ্বাস কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে এই খামার থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব ইনশাআল্লাহ্।
তিনি আরও বলেন, আগে আমার খামারটি কাঁচা ছিল। এখন উই ফর দেম আমাকে নতুন করে এটি পাকা করে দিয়েছে। আগে ৫০০ মুরগি ছিল, তবে এখন ৬০০ থাকবে। আমার আত্মবিশ্বাস আল্লাহর রহমতে আমি এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে পারব। এই খামার দিয়ে আমি লাভবান হতে পারব। তাদের এই সূর্যোদয় প্রজেক্ট আমার জন্য আশীর্বাদ। আমি উই ফর দেম এবং ঢাকা পোস্টের কাছে কৃতজ্ঞ। অসহায় মানুষদের জন্য এমন ভালো উদ্যোগ যেন অব্যাহত থাকে এটাই আমার চাওয়া।
প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি সহায়তা ছাড়া কখনও অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা বা ভাতা পায়নি হারুন উর রশিদ। পিতৃহীন পরিবারে ছয় ভাই, তিন বোন। বিয়ের পর যে যার মতো আলাদা হয়ে থাকছে। কেউ কৃষি কাজ, কেউ মানুষের দোকানে কাজ করে। শুধু বিয়ে হয়নি হারুনের।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার নিজের পড়াশুনার জন্য টিউশনি (প্রাইভেট) করেছি। মাস শেষে টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতাম। এইচএসসি পাসের পরও অন্যদের প্রাইভেট পড়িয়েছি। অনেক জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। কোথাও চাকরি না পেয়ে অনেক কষ্ট হয়েছে। হতাশ হয়েছিলাম। পরে চাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছি। সংসারের উন্নতি করার জন্য এনজিও থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মুরগির খামার করেছিলাম। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খামারটি ভেঙে পড়ে।
হারুনের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলে জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারে না। লাঠি ছাড়া চলাফেরা করা কষ্টকর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও হারুন নিজে থেকে কিছু করতে চায়। ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে খামারও করেছিল। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে ছেলে বেকার ছিল। এখন নতুন খামার হয়েছে। ভালো কিছু হবে বলে আশা করছি।
স্থানীয় বিড়িশ্রমিক শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হারুনের কর্মচেষ্টা আছে। উই ফর দেম সংগঠনের সহায়তায় এখন হারুন ভালো কিছু করতে পারবে। তার আগেও পোল্ট্রি ফার্ম ছিল কিন্তু ঝড়বৃ-ষ্টির কারণে বেশি দিন টিকেনি।
একই এলাকার আরেক যুবক আসলাম মিয়া বলেন, এটা তো অনেক বড় কাজ। হারুন ভাই বেকার ছিল। এবার তার গতি হয়েছে। এখন শুধু পরিশ্রম আর নিজের মনোবল ঠিক রাখতে পারলে তার জন্য ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে।
হারুন উর রশিদ ২০০৪ সালে হারাগাছ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (জিপিএ ৩.৮০) পাস করেন। পরে তিনি ২০০৬ সালে হারাগাছ মডেল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি (জিপিএ ৩.৪০) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পারিবারিক অসুবিধার কারণে আর তার পড়াশুনা বেশি দূর গড়ায়নি। তিনি প্রতিবন্ধী কোটায় সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু যোগ্যতার মিছিলে চাকরিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
এসপি