কখনো ভাবিনি ঘুষ ছাড়া মেয়ের চাকরি হবে
‘সব সময়ই আমার স্বপ্ন ছিল আমি যেন বড় হয়ে কোনো একটা ভাল যায়গায় যোগদান করতে পারি। বাংলাদেশে সাধারণত বলা হয় টাকা ছাড়া কোনো চাকরি হয় না, এইটা ভুল ধারণা। যেটা আমি এখানে এসে দেখতে পেরেছি। আমাদের পুলিশ সুপার স্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে সততার সঙ্গে সুন্দরভাবে সিলেকশন করেছেন।’
গত সোমবার (৮ নভেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টায় বাগেরহাট নতুন পুলিশ লাইন্স মিলনায়তনে কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর এসব কথা বলেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহ গ্রামের কৃষক বাবার মেধাবী মেয়ে জুঁই।
স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই এবং পুলিশ সুপার স্যারের মত সৎ এসপি হতে চাই।
জুঁইয়ের হতদরিদ্র বাবা জিল্লুর রহমান বলেন, সব সময় চেয়েছি আমার মেয়েরা কিছু করুক। ছেলে নেই তো কী হয়েছে। আল্লাহ মেয়েতো দিয়েছেন। তাই চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে খেয়ে না খেয়ে মেয়েদের পড়াশোনা চালু রেখেছি। কিন্তু মেয়ের চাকরি নিয়ে খুবই চিন্তায় ছিলাম। কারণ আমার টাকাও নেই, আবার বড় কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। কখনো ভাবিনি ঘুষ ছাড়া আমার মেয়ের চাকরি হবে। তারপরও আল্লাহর রহমতে মেধার জোরে আমার মেয়ের চাকরি হয়েছে। কোনো প্রকার সুপারিশ ও ঘুষ ছাড়া চাকরি দেওয়ায় পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
শুধু জুঁই নয়, কনস্টেবল পদে বাগেরহাট জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩০ জনের বেশিরভাগই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। বিনা পয়সায় চাকরি পেয়ে খুশি তারা। গত সোমবার রাত দেড়টার দিকে পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের নাম ও রোল নম্বর ঘোষণা করলে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয় নতুন পুলিশ লাইন্স মিলনায়তনে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চাকরিপ্রাপ্তরা বাবা-মাসহ অভিভাবকদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। সকলের দোয়া চান তারা।
রামপাল উপজেলার বাশতলী এলাকার বর্গাচাষি শেখ শুকুর আলী বলেন, আমার ছেলে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে। আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। গরিব মানুষ, খেটে খাই। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এইভাবে চাকরি পাওয়া যায়। আল্লাহর রহমতে ছেলেটার চাকরি হলো। আমি পুলিশ ভাইদের ধন্যবাদ জানাই।
এদিকে ১৩০ টাকা ব্যয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে মেয়ের চাকরি হওয়ায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কচুয়া উপজেলার বারুইখালী গ্রামের সবজি বিক্রেতা মোস্তফা মোল্লা। খুশিতে চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল হতদরিদ্র এই বাবার। কথাই বলতে পারছিলেন না।
কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত মোস্তফা মোল্লার মেয়ে লাবনী খানম বলেন, আমরা সাত বোন, কোনো ভাই নেই। বাবা-মায়ের সব চিন্তা আমাদের নিয়ে। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে এসএসসি পাশের পর থেকে বিভিন্ন দফতরে চাকরির চেষ্টা করেছি, হয়নি। আল্লাহর রহমতে চাকরি হয়েছে। এখন সংসারের পাশাপাশি ছোট বোনদের পড়াশোনার জন্যও কিছু টাকা দিতে পারব। এই বলে বাবাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন লাবনী খানম।
অনলাইনে আবেদনের পর ২৯ নভেম্বর থেকে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে ৩১ জন নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে বাগেরহাট জেলা পুলিশ। সব প্রক্রিয়া শেষে সোমবার রাত দেড়টায় কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ২৫ জন ছেলে ও ৬ জন মেয়ের নাম ঘোষণা করেন পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক।
ফলাফল ঘোষণা শেষে পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক বলেন, শতভাগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আমরা পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি মেধাবীদের পুলিশ সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার। ভবিষ্যতেও সব নিয়োগে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকে আমরা খুবই সতর্কতার সঙ্গে দালাল ও প্রতারক চক্রকে দমন করার চেষ্টা করেছি। এর অংশ হিসেবে কনস্টেবল পদে নিয়োগের দালালি করার অপরাধে তিনজন প্রতারককে আটক করেছিলাম আমরা।
তানজীম আহমেদ/আরএআর