মেয়ে মিষ্টি নিয়ে রেস্তোরাঁয় বসা, ঢুকতে দেয়নি বাবাকে
মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাবাকে ফোন করে হোটেলে ডাকে মিষ্টিমুখ করাবে বলে। মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে খুশিমনে ছুটে আসেন বাবা তারা বাঁশফোড়। তখন স্কুলড্রেস পরিহিত মেয়েটি হোটেলের ভেতরে মিষ্টি নিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ মেয়েটির ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ফিসফিস করে তার বাবা বললেন, ‘ভেতরে যেতে মানা করছে হোটেল মালিক’। মেয়েটি ফোন রেখে হোটেল মালিককে ডেকে বলল, ‘ওনাকে ভেতরে আসতে দিন, উনি আমার বাবা।’ সায় দিলেন না হোটেল মালিক, উল্টো রেগে গিয়ে বললেন, ‘ উনি তোমার বাবা! তার মানে তুমি...! জলদি বাইরে যাও। হোটেলে ঢুকেছ কেন? জানো না তোমাদের হোটেলে বসতে মানা?’
নীলফামারীর সৈয়দপুরে হরিজন সম্প্রদায়ের এসএসসি পাস শিক্ষার্থী ও তার বাবার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এক বছর আগের।
সোমবার (৮ নভেম্বর) বিকেলে রংপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দেবী চৌধুরানী পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র ও রংপুর জেলা হরিজন ঐক্য পরিষদের আয়োজনে সাংবাদিকদের কাছে ঘটনাটি তুলে ধরেন দেবী চৌধুরানী পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুস সামাদ।
হরিজন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ আবাসিক ব্যবস্থা, করোনাকালীন প্রণোদনা প্রদান, চাকরির নিশ্চয়তা, স্থায়ীকরণসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন আয়োজকরা।
আরও পড়ুন : অলস টাকায় বিলাসবহুল বাড়ি, থাকছেন কেয়ারটেকার
লিখিত বক্তব্যে প্রকল্প সমন্বয়কারী আব্দুস সামাদ বলেন, সৈয়দপুরের ওই শিক্ষার্থী এখন কলেজে পড়াশোনা করছে। তার প্রশ্ন ছিল, ‘আমার পোশাক দেখে তো হোটেল মালিক সেদিন বুঝতে পারেননি আমি হরিজন। অথচ আমার বাবাকে দেখে তারা বুঝতে পেরেছিল। প্রতিদিন শহরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হরিজন জনগোষ্ঠীর লোকেরা হোটেলে বসে খাচ্ছেন, ঘুরছেন কেউ তো তাদের বাধা দেয় না। কিন্তু যে মানুষটি জানে আমরা হরিজন, তারাই বাধা দেয়, হোটেল থেকে বের করে দেয়।’
সামাদ আরও বলেন, বর্তমানে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের জাত-পেশায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের সন্তানরা পড়ালেখা করেও চাকরি পাচ্ছেন না। বিভিন্ন মহল থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে হরিজন জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে শতকরা ৮০ ভাগ লোককে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, ২০২০ সালের প্রথম দিকে আউটসোর্সিংয়ে ২১৩ জনের একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। যেখানে হরিজন জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে মোট সংখ্যার ৮০ ভাগকে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও যোগ্য প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও দু-একজন ছাড়া বাকি কেউই চাকরি পাননি। অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আগে যাদের চুক্তিভিত্তিক বা মাস্টাররোলে চাকরি হয়েছে, তাদের চাকরিও স্থায়ী হয়নি।
বাংলাদেশ হরিজন মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক শ্রী মিলন বাঁশফোড় বলেন, নগরের নিউ জুম্মাপাড়া ও সদর কলোনি, মাহিগঞ্জসহ আরও যেসব বস্তিতে হরিজন জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন যাপন করছে, একই ঘরে ৪-৫ জন শিশু, বৃদ্ধ ও যুবক ছেলেমেয়ে মিলে একেকটি পরিবার বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছে। তারা দেশের নাগরিক হিসেবে মৌলিক চাহিদা ও সুবিধাবঞ্চিত। সেখানে পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও আবাসন-সুবিধা নেই।
আরও পড়ুন : আপন ঠিকানা পূর্ণ করল মরিয়মের স্বপ্ন
কোথাও কোথাও ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এ জনগোষ্ঠীর লোকেরা। অথচ করোনা মহামারির শুরু থেকে দলিত হরিজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে দিনরাত কাজ করেছে। অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেছে। কিন্তু হরিজন শ্রমিকরা মহামারিতেও কোনো প্রণোদনা সুবিধা বা ঝুঁকিভাতা পাননি।
সংবাদ সম্মেলন থেকে অবিলম্বে হরিজন জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে আবাসিক সুবিধা প্রদান, পানিনিষ্কাশনের জন্য উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিনামূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশেষ শিক্ষাভাতা বৃদ্ধি, চাকরিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও হাসপাতালে ডোম নিয়োগে অগ্রাধিকার প্রদান, মাস্টার রোল চাকরি স্থায়ীকরণ, আউটসোর্সিংয়ে অগ্রাধিকার, হোটেলে বসে খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা ও পুষ্টি ভাতাসহ নাগরিক সুবিধার আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এ সময় এনএনএমসি ফাউন্ডেশনের রংপুর জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট মনিলাল দাস, হরিজন জনগোষ্ঠীর নারীনেত্রী কল্পনা রানী, মণিকা রানী, সারিত্রী রানী, ওবায়দুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ