আশুলিয়ায় ভয়ঙ্কর অটোরিকশা ছিনতাই চক্র
পেশার শুরুটা ছিল পোশাক শ্রমিক বা রিকশাচালক হিসেবে। বিভিন্ন স্থানে চুরি ও ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে পা রাখেন তারা। তৈরি করেন একটি চক্র। শুরু হয় খুন বা জখম করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই। কয়েকদিনের ব্যবধানে হত্যা করেন দুই অটোরিকশা চালককে। হত্যাসহ বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তে নামে। বের হয়ে আসতে থাকে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফাঁদে ধরা পড়েছেন চক্রটির ছয় সদস্য। এদের মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন দুইজন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- শেরপুরের ঝিনাইগাতি থানার বাকাকুড়া গ্রামের বাসির উদ্দিনের ছেলে লিটন (৩১) শেরপুর সদর থানার বাকেরকান্দা গ্রামের ইকবাল হোসেনের ছেলে মোর্শেদ আলম (৩০, একই এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে শহিদুল ইসলাম (৩৯), টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার কাজিবাড়ি গ্রামের মজিবর মোল্লার ছেলে আসিফ মোল্লা (২৪), নরসিংদীর রায়পুর থানার হাইলমারা গ্রামের মৃত নুর ইসলামের ছেলে তারেক মিয়া (৪৪) ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার পূর্বকোরিয়ার গ্রামের মৃত আবু সুফিয়ানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (৩৫)।
এদের মধ্যে লিটন ও মোর্শেদ আশুলিয়ার ডেন্ডাবরের কবরস্থান রোডে, শহিদুল গাজীপুরের কাশিমপুর থানার আন্ধারমানিক মাধবপুর এলাকায়, আসিফ আশুলিয়ার বটতলা এলাকায়, তারেক আশুলিয়ার কন্ডার মধুপুর দুইতলা মসজিদের পাশে ও সাখাওয়াত গাজীপুরের সফিপুরর বাজার সংলগ্ন রূপনগর এলাকায় ভাড়া থাকতেন। আসিফ, তারেক, শহিদুল ও সাখাওয়াতকে দুইদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। লিটন ও মোর্শেদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় তিন মাস আগে তারেক, আসিফ, ফেরদৌস, মোর্শেদ, লিটন, সাখাওয়াত ও শহিদুল নামে ৭ জন মিলে অটোরিকশা চোর চক্র গড়ে তোলেন। প্রতিনিয়ত তারা বিভিন্ন কায়দায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই ও চুরি করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন।
চক্রটির দুই সদস্য তারেক এবং আসিফ ছিলেন তালা ভাঙা ও খোলায় পারদর্শী। যে কোনো তালা তারা নিমিষেই খুলতে অথবা ভাঙতে পারতেন নিমিষেই। এজন্য তারা দুজনই দুই হাজার টাকা করে বেশি দাবি করেন। অন্য সদস্যরা বলেন- একটি অটোরিকশা ছিনতাই করে বিক্রি করলে পাওয়া যায় ২০ হাজার টাকা। তার মধ্যে চার হাজার টাকা বাদ দিলে ভাগে টাকার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। এটা মানা যাবে না। তখন তারেক ও আসিফ আলাদা গ্রুপ করার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে লিটন মানুষকে অজ্ঞান বা হত্যারর অভিনব কায়দা রপ্ত করেন। তিনি জানতে পারেন মাথার পেছনের একটি জায়গায় আঘাত করলেই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। চিন্তা করেন এক্সপেরিমেন্ট করার। পরে তারই বন্ধুর মাথার পেছনে আঘাত করে এক্সপেরিমেন্ট করেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি সফলও হন। এই লিটনকে নিয়েই তারেকরা বিভক্ত হয়ে তৈরি করেন নতুন একটি গ্রুপ। এদের মধ্যে আসিফ দুই গ্রুপেই কাজ করতে থাকেন। সঙ্গে আরেক জন শফিকুলকে নেন অটোরিকশা বিক্রির কাজে। শুরু হয় তাদের রিকশা ছিনতাই মিশন। স্থান হিসাবে বেছে নেন আশুলিয়ার কাইচাবাড়ি, ইপিজেড এলাকার বলিভদ্র বাজার, পলাশবাড়ি এলাকার বাতানটেক, নবীনগরের কুরগাঁও ও গাজিরচট এরাকার নির্জন স্থান। হত্যার পর অটোরিকশা ছিনতাইয়ের একটি ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রটির সদস্যদের।
হত্যার একটি ঘটনায় তদন্তে দায়িত্ব পেয়েছিলেন আশুলিয়া থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জসিম উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চক্রটি প্রথমেই টার্গেট করে নতুন অটোরিকশা চালক। পরে ভোর রাত ও গভীর রাতে ভাড়া করে নিয়ে যায় এসব স্থানের নির্জন জায়গায়। পরে পেছন থেকে চালকের মাথার পেছনের নার্ভে আঘাত করে লিটন। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যান চালক। পরে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যান তারা। কোনো কোনো চালক অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। কেউ হারিয়ে ফেলেন কর্মক্ষমতা। প্রতিটি মিশনে ব্যবহার করা হয় লোহার রড, তিন কোণা কাঠ ও চাপাতি। এসব দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করেই দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে তারা।
এখন পর্যন্ত তাদের এমন পাঁচটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুই রিকশাচালক নার্ভে আঘাত পেয়ে মারা যান। গুরতর আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিছেন তিনজন। আহতরা অস্থায়ী হওয়ায় দুইজনের সন্ধান করেও পাওয়া যায়নি। তবে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলে একজন আহতের সন্ধান। তার নাম রিপন (২৮)। তিনি আশুলিয়ার কাইচাবাড়ি এলাকায় থেকে অটোরিকশা চালাতেন। গত ৩০ ডিসেম্বর অটোরিকশা নিয়ে বের হন। গভীর রাতে আশুলিয়ার সম্ভার পাম্প থেকে তিনজন অটোরিকশা ভাড়া করে কাইচাবাড়ি যান। পরে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে অটোরিকশার সিটে বসে তিন কোণা কাঠের লাঠি দিয়ে মাথার পেছনের নার্ভে আঘাত করেন। নিমিষেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পরে অটোরিকশা নিয়ে চম্পট হয় তারা। রিপনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা হলেও তিনি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তিনি এখন পাগল প্রায়।
এছাড়াও আশুলিয়ার গাজিরচট ও ডেন্ডাবর এলাকায়ও একই ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সন্ধান করা হলেও অস্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় তাদের সন্ধান মেলেনি।
গত ১৩ জানুয়ারি রাতে একই কায়দায় আশুলিয়ার কাইছাবাড়ির গেড়াবাড়ি এলাকার একটি পরিত্যক্ত মাঠে নিয়ে মোফাজ্জল হোসেনকে (৪০) আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তিনি নওগাঁর দামুরহাট থানার আড়ানগর গ্রামের মোজাফফর হোসেনের ছেলে।
পরবর্তীতে ২২ জানুয়ারি ভোরে আশুলিয়ার আয়নাল মার্কেট এলাকার বাঁশঝাড় মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় নিয়ে মাথার একই স্থানে আঘাত করে অটোরিকশা চালক শাহিন উদ্দিনকে (২২) হত্যা করেন এই চক্রের সদস্যরা। তিনি পাবনা জেলার মৃত হারুন ব্যাপারীর ছেলে।
একই ঘটনার অপর তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আশুলিয়া থানা উপপরিদর্শক (এসআই) আবু নাসের জানান, দুই এলাকায় অটোরিকশা চালকের মাথার একই স্থানে আঘাত করে চালককে হত্যার ঘটনাই জানান দেয় এটি একই চক্রের কাজ। পরপর দুটি একই রকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়। গত ২৩ জানুয়ারি স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে সাখাওয়াত ও শহিদুলকে কালিয়াকৈর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কালিয়াকৈর থেকে লিটন, ডেন্ডাবর কবরস্থান রোড থেকে মোর্শেদ, আশুলিয়ার শ্রীপুর এলাকা থেকে আসিফ ও তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছিনতাই চক্রটির সকলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সবাইকে কোনো ধরনের অটোরিকশা ক্রয়ের সময় অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ক্রয় করার অনুরোধ জানাই। প্রলোভনে পড়ে কম টাকায় চোরাই অটোরিকশা ক্রয় থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানান তিনি।
মাহিদুল ইসলাম/আরএআর