সবুজ গালিচার বুকে নয়নাভিরাম পানপাতার ঘর
শুধু অভ্যাসগত কারণেই নয়, ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পানের ব্যবহার প্রচলিত। বিয়েশাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পান। ধর্মীয় উৎসব ও পূজা-পার্বণেও পান অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীনকালে অভিজাত শ্রেণিতে পানদানিতে পান পরিবেশন ছিল লোকজশিল্প। আবহমানকাল থেকে পানের কদর কখনোই কমেনি।
কিন্তু এই পান চাষের পেছনের গল্প কজন জানে? পানের আসল ঘরের ভেতর-বাহির কেমন, সেটি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের স্থানীয় তরুণ আবদুল্লাহ ও নারী পানচাষি লক্ষ্মী রানী ব্যাপারী বরজে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন।
দেখে মনে হয়, ফসলের সবুজ গালিচার ফাঁকে ফাঁকে চৌকোনা ঘর। ঘরগুলোকে পাখির চোখে মনে হবে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে বুনন করা। আবার মনে হবে, পাটের শুকনা রশি দিয়ে ওপরের সমান্তরালে ছাদ তৈরি করা হয়েছে। মনে হতে পারে ধূসর রঙের শামিয়ানা, কিন্তু তা নয়।
আসলে পানের ঘরের জন্য বাঁশ, বাঁশের চাটাই, নলের ঝাঁটি, শণ, ধইঞ্চা ও পাটকাঠি ব্যবহার করা হয়। এমনকি খেজুরপাতা ও কলাপাতাও ব্যবহার হয় তার সুরক্ষার জন্য।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের গুয়াচিত্রা বাজার-সংলগ্ন বীরমহল গ্রাম ও এর আশপাশের প্রায় ১০০ পরিবার পান চাষের সঙ্গে যুক্ত। পানের সাজানো একেকটা বড় বড় ঘর হলো প্লট। এসব প্লটের ভেতরে থাকা পানগাছের একেকটা সারি বা মাটির একেকটা সারিকে বরজ বলা হয়। আর এই বরজগুলো থেকে উৎপাদিত পানই চলে যায় স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বরজ থেকে তুলে শত শত পান ওপর-নিচ করে কলাপাতায় বাঁধার পর মাথায় তুলে যখন শ্রমিকরা নিয়ে যান, তখন বাহির থেকে কেবল পানের বোঁটাই দেখা যায়। খুচরা বাজারে চলি বা ছলি এবং বিড়া হিসেবে পান বিক্রি হয়। ৩৬টি পানে এক ছলি আর তার দ্বিগুণ ৭২টিতে হয় এক বিড়া।
পান বরজ থেকে তোলার পর আকার অনুযায়ী এক পাশ করা হয়। কোনো পানে সামান্য ত্রুটি থাকলে তা ব্লেড দিয়ে নিখুঁত হাতে দ্রুততার সঙ্গে কেটে ফেলা হয়। সেগুলো নিজেদের খাওয়ার জন্য বা কম মূল্যে বিক্রির জন্য রাখা হয়।
পানের বরজকে অতিরিক্ত আলো-বাতাস থেকে সুরক্ষিত রাখতে ঝাঁটির ছাওনি দিতে হয়। একেকটি ছোট্ট অংশে ৯ মুঠি ঝাঁটি দিতে হয়। তারপর চারপাশে সমানভাবে আটকে দিতে হয়। এভাবেই তৈরি হয় পানের ঘর। আর এই ঘরই পানের সুসজ্জিত বেষ্টনী।
বরজের ছাওনিতে যে ঝাঁটি ব্যবহৃত হয়, বাজারে তেমন এক হাজার ঝাঁটির মূল্য ৩০ হাজার টাকা। ১০০ শতাংশ জমির একটি প্লটে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ঝাঁটির প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রতিটি পানগাছের গোড়ায় নতুন মাটি দিতে হয়। তাতে বরজে ও প্লটে প্রচুর মাটির প্রয়োজন হয়। এ জন্য আলাদা শ্রমিক দিয়ে বরজের আশপাশ থেকে মাটি খনন করে আনতে হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি হেক্টর জমিতে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। লাভও হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা।
পানচাষিদের পানের অনেক যত্ন নিতে হয়। বীরমহল গ্রামের নারীরাও পানের যত্ন নেন। তেমনই একজন লক্ষ্মী রানী ব্যাপারী। বিয়ে হয়েছে ২৫ বছর হলো। বাড়ির মধ্যেই তার বড় পানের বরজ। বিয়ের পর থেকেই তিনি বরজের দেখাশোনা করেন বলে জানান। লক্ষ্মী রানী বলেন, ‘পানচাষিরা ভালো নেই। বরজের ওপর নির্ভর করেই সংসার ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। বরজ রক্ষা করতে গিয়ে ঋণ নিতে হয় আমাদের।’
তার কথার সত্যতা মেলে বাজারের এক পান দোকানির কথায়। ওই দোকানি জানান, মাঝারি পানের ছলি ১৫ টাকায়ও কেনেন তারা। পানচাষিদের অবস্থা যে খুব খারাপ, তা এতেই বোঝা যায়।
মনি শংকর গায়েনেরও বীরমহল গ্রামে রয়েছে পানের বরজের একাধিক প্লট। ৫২ শতাংশের একটি প্লটে পানের বরজ থেকে এ বছর দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার পান বিক্রি করেছেন তিনি। তিনি প্রায় ছয় বছর ধরে পান চাষের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তবে তার বাবারও পানের বরজ ছিল।
ঝালকাঠির পান গ্রাম হিসেবে পরিচিত সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বীরমহল, একশারাপাড়া ও জুথিয়া গ্রাম। পূর্বে কবি কামিনী রায়ের বাড়ি-সংলগ্ন বাসন্ডার বারৈবাড়ি উল্লেখযোগ্য পান গ্রাম ছিল। এ ছাড়া বর্তমানে নলছিটি উপজেলার বারৈকরন ও সরই উল্লেখযোগ্য পান গ্রাম। রাজাপুর উপজেলায়ও পানের ব্যাপক চাষ হয়।
ঝালকাঠি শহরটি ইটপাথরে ঠাসা হলেও জেলার বীরমহলের মতো গ্রামগুলোতে এখনো দেখা মেলে ধান চাষে গরু আর লাঙলের ব্যবহার। অনিন্দ্যসুন্দর ফসলের মাঠ। মাছ ধরার জন্য দুজন মিলে টিনের কাতি দিয়ে জলাশয় সেচে ফেলা— এককথায় এই গ্রামগুলোই যেন বাংলার আসল মুখচ্ছবি। যেখানে আশপাশের ঘরবাড়িগুলো ছুঁয়েও দেখা যায় পানের বরজ। এতে যেকোনো টিনশেড ভবনের মালিক আর পান বরজের মালিকের মধ্যে অটুট সম্প্রীতিই প্রমাণ করে।
মনি শংকর গায়েনের বরজে মজুরিভিত্তিক কাজ করতে এসেছেন জাহাঙ্গীর ইসলাম। যার নিজেরও পানের বরজ আছে। তিনি জানান, সরকার যদি আমাগো দিক তাকায়, তাতে আমরা কাজবাজ করে পান চাষ করে চলতে পারি। বর্তমান বাজার যা, তাতে পুষিয়ে থাকা খুবই সমস্যা। বদলার (সহযোগী) টাকা-টোকা দেতে খুব সমস্যা। সরকার যদি আমাদের দেখে, তাহলে একটু বেচে চলা যায়। না হলে সমস্যা, বিশেষ করে করোনাকালে। নিজেরটার দাম সে রকমের নাই বিধায় নিজেরটাও সামলাইতে হয়, অন্যের জায়গাও কাজ করতে হয়।
আরেক চাষি তাপস হাওলাদারের মা জানান, তাদের নিজেদের ১০০ শতাংশ জায়গায় একটি প্লটে ৩০০ বরজ আছে। তার স্বামী মণীন্দ্র হালদারও পান চাষে যুক্ত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, পান চাষে কৃষি ব্যাংক থেকে আমরা কোনো সহযোগিতা পাই না। আবার কৃষি অফিস (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর) থেকেও পানের রোগের ব্যাপারে পরামর্শ পাই না। আমরাই নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সমাধান করি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পানে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। সাধারণত কাণ্ড পচা রোগ, পাতা পচা রোগ, শিকড় পচা রোগ, শিকড়ে গিঁট এবং কখনো পানগাছ ঝরে পড়ার মতো রোগ হয়। পানে যেসব পোকামাকড় হয়, তার মধ্যে সাদা মাছি পোকা, কালো মাছি পোকা ও ছাত্রা পোকা উল্লেখযোগ্য।
পানগাছ পানি পছন্দ করে না। ঝোড়ো হাওয়া ও ঠান্ডা বাতাস থেকে পানগাছকে রক্ষা করতে হয়। আবহাওয়ার বৈরী আচরণ বছরের যেকোনো সময় যেকোনো ফসলের আবাদ করা কৃষককে মেনে নিতে হয়।
‘ষোলো চাষের মূলা, তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান’— খনার বচন উদ্ধৃতি দিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. ফজলুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পান একটি অর্থকরী ফসল। এ বছর ঝালকাঠিতে ৪৯৬ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন।
তিনি আরও বলেন, পানের অনেক গুণ আছে। ডায়াবেটিস, দাঁতের ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, পোড়া, কাটা ঘা, ঠান্ডা ইত্যাদি রোগের জন্য পান মহৌষধের কাজ করে। চাষিদের সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবহন, বিশুদ্ধ সেচ, জলাবদ্ধতা, জলোচ্ছ্বাস, অতিখরা, ঠান্ডার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় চাষিদের।
নিরাপদ পান উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কর্মসূচির মাধ্যমে চাষিদের মাঝেমধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। ‘পানের পাতাটা যেহেতু পুরোটাই আমরা খাই, তাই কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত’, পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি আরও জানান, রোদ, খরা ও পানিসহিষ্ণু পানের জাতের দরকার। ঠান্ডার সময় বরজে পলিব্যাগ দরকার। চাষিদের যেকোনো সমস্যায় যেকোনো সময় জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা যাবে।
উল্লেখ্য, পানের বরজই পানের ঘর। এখানেই পান বেড়ে ওঠে। পান চাষের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের বারই বলা হয়। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার একটি এলাকার নাম বারইকরণ। এইচ. বেভারেজ লিখিত The District of Bakerganj, its History and Statistics (1876), এইচ.সি সাদারল্যান্ড লিখিত A Report on Bakerganj in Principal Heads of the History and Statistics of the Dacca Division (1868), কে.জি.এম লতিফুল বারী সংকলিত Bangladesh District Gazetteers (1978), অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. মোহাম্মদ আবদুল লতীফ লিখিত ‘বৃহত্তর মঠবাড়িয়ার ইতিহাস’ এবং মুহম্মদ মুহসিন লিখিত 'চরিতাভিধান'— এই গ্রন্থগুলোর তথ্য অনুযায়ী, যখন ঝালকাঠি, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা সৃষ্টি হয়নি বরং বাখরগঞ্জের অধীনে ছিল এসব এলাকা, সেই বাখরগঞ্জ জেলা সৃষ্টিরও আগে ১৭৮১ সালে সন্দ্বীপ থেকে খুলনা পর্যন্ত পদ্মার দক্ষিণের আর মেঘনার পশ্চিমের সমগ্র অঞ্চলের জন্য যে একজন সিভিল জজ নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই সিভিল জজের সদর দফতর ছিল বারইকরণে।
এমনকি ১৭৮৪ সালে সুন্দরবন কমিশনার হিসেবে মি. মিডলটনও যোগদান করেন বারইকরণে। ঝালকাঠি বা নলছিটিরও বহু আগে ১৭৯০ সালে বারইকরণে থানা স্থাপন করা হয়। তখন থেকেই বারইকরণ নাম দেখে বোঝা যায়, পান চাষের কয়েক শ বছরের ইতিহাস রয়েছে এ অঞ্চলে। তবে সিনেমার আংশিক ট্র্যাজিডির মতো চাষিদের দুঃখ বরাবরই।
এনএ