৬ ঘণ্টায় এত ইলিশ ধরল কারা?
মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কমপক্ষে দুই হাজার মণ ইলিশ উঠেছে। মাছ নিয়ে বড় কোনো ট্রলার না এলেও ছোট ছোট ট্রলারে করে নিয়ে আসা হয়েছে এসব মাছ।
আড়তদারদের দাবি, বরিশালের বিভিন্ন নদী থেকে ধরা ইলিশ উঠেছে প্রথম দিনে। সাগরের মাছ আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
এদিকে ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে দুই হাজার মণ ইলিশ ওঠায় যথারীতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। এত অল্প সময়ে এত বেশি মাছ ধরা সম্ভব নয় বলে দাবি তাদের। কেউ কেউ বলছেন, অভিযানে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরা মাছ প্রথম দিন বাজারজাত করেছেন জেলেরা।
ক্রেতাদের দাবি- এবারের ইলিশ রক্ষা অভিযান হয়েছে লোক দেখানো। বিশেষ করে মেঘনা তীরবর্তী এলাকায় ইলিশ ধরা বন্ধই করতে পারেনি প্রশাসন। তার প্রমাণ প্রথম দিনে একটি বাজারে এত বেশি ইলিশ বিক্রি। এই বাজারে বড় ইলিশের পাশাপাশি জাটকাও বিক্রি হতে দেখা গেছে।
যদিও মৎস্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া ইলিশ রক্ষা অভিযান শতভাগ সফল হয়েছে। কোথাও জেলেরা ইলিশ ধরতে পারেনি। যারা চেষ্টা করেছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
সরেজমিনে পোর্ট রোডের জেলা মৎস্য পাইকারী বাজার ঘুরে জানা গেছে, সকাল ৬টা থেকেই বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেরা ছোট ছোট ট্রলার বোঝাই করে ইলিশ নিয়ে এসেছেন। এগুলো পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে। জেলেদের বিক্রির পরপরই তা আড়তে প্রক্রিয়াজাতের কাজ শুরু হয়। বরফ দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় কার্টনজাত করে ট্রাকে করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে এসব মাছ। প্রতিটি আড়তেই ইলিশ প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যস্ততা দেখা গেছে।
কামাল সিকদার আড়তের মালিক শফিক সিকদার বলেন, ভোর থেকেই বিপুল পরিমাণ ইলিশ পোর্ট রোডে উঠেছে। অতিরিক্ত ইলিশ ওঠায় দরপতন হয়েছে। কম দামে বিক্রি হয়েছে। এতে আড়তদারদের বেশি লাভ হবে না। সাধারণ ক্রেতারা অল্প টাকায় ভালো ও বেশি ইলিশ খেতে পারবেন। নদীতে যদি কম ইলিশ ধরা পড়তো তাহলে বাজারে দাম বেশি হতো। তখন আমাদের লাভ হতো বেশি।
মাছ বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কমপক্ষে দুই হাজার মণের মতো ইলিশ উঠেছে পোর্ট রোড বাজারে। এই ইলিশ আশপাশের নদীর ইলিশ। সমুদ্রের ইলিশ আসবে আরও সাত দিন পর। কারণ নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরে কেবল জেলেরা নদী ও সমুদ্রে রওয়ানা হয়েছেন। তারা মাছ ধরবেন, তারপর নিয়ে আসবেন।
আরেক বিক্রেতা আব্দুর রশিদ বলেন, আজকে পোর্ট রোডে অনেক ইলিশ মাছ উঠেছে। গত বছরের অভিযানের পরও এত ইলিশ ওঠেনি।
মাছ বিক্রেতা মো সাজু বলেন, প্রথম দিন এত ইলিশ কোথা থেকে এলো বুঝতে পারছি না। বড় সাইজের মাছ এসেছে, যার অধিকাংশের পেটে ডিম আছে।
ইলিশ কিনতে আসা স্কুলশিক্ষিকা শিরিন সুলতানা তন্বি বলেন, অভিযান শেষ না হতেই এত ইলিশ বাজারে ওঠায় এটা স্পষ্ট যে এবারের অভিযানে মা ইলিশ নিধন ঠেকানো যায়নি। মৎস্য অধিদফতর যাই বলুক, নদীতে জেলেরা যাওয়ার আগেই বাজার মাছে সয়লাব হয়ে যায় কীভাবে? বাজারে যে মাছ উঠেছে তার অধিকাংশের পেটে ডিম এবং চোখ লাল।
তিনি আরও বলেন, মাছ অনেকদিন প্রক্রিয়াজাত করে রাখলে চোখ লাল হয়ে যায়। অভিযানের মধ্যেও জেলেরা মাছ ধরেছে সেটাই প্রমাণ করে এই লাল চোখ ইলিশ।
আরেক ক্রেতা আমির হোসেন বলেন, ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। পোর্ট রোডে প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রি হচ্ছে। এটা বন্ধ করা উচিত। জাটকা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করা না গেলে ইলিশ ভাগ্যে জুটবে না।
বরিশাল জেলা মৎস্য পাইকারি বাজারের সভাপতি নিরব হোসেন টুটুল বলেন, অভিযান শেষ হওয়ায় রাত ১২টা থেকেই জেলেরা ইলিশ ধরতে শুরু করেছেন। আজকে ভালো পরিমাণ মাছ উঠেছে। আরও দুই-একদিন মাছগুলো নদীতে থাকবে। এরপরই সাগরে চলে যাবে। এবার সাগরে যে পরিমাণ জেলেরা গেছেন তাতে আশা করি প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে।
তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবারে ইলিশের পরিমাণ কম হবে। গত বছর প্রথম দিনে ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছিল ২৫ হাজার টাকায়। এ বছর প্রথম দিনেই বিক্রি হচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়।
পাইকারি আড়তদাররা জানান, ১ কেজি ২০০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১ হাজার টাকা, ১ কেজি ৪০০ গ্রাম থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ১০০ টাকা, ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০ টাকা কেজি, দুটিতে ১ কেজি ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ৬০০ টাকা, তিনটিতে এক কেজি ওজনের ইলিশ ৫০০ টাকা এবং ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় জাটকা বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, গত বছর বরিশালে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছিল। এ বছর আশা করছি গত বছরের রেকর্ড ভেঙে যাবে।
মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে আমরা পুরোপুরি সফল উল্লেখ করে বিমল চন্দ্র বলেন, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। এজন্য জেলেরা ইলিশ ধরতে পারেননি। তবে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে বাজারে এত ইলিশের আমদানি হওয়ার বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর