পাবনায় ধান-পাটকাঠি শুকানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে ব্রিজ
পাবনার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামীণ এলাকায় বিল ও মাঠের মধ্যে সংযোগ সড়ক ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে ব্রিজ। মানুষ পারাপার হতে না পারলেও খড়ের পালা দেওয়া, পাটকাঠি বা ধান শুকানোর কাজে ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। অপ্রয়োজনীয় এসব সেতু নির্মাণে সরকারি অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে।
অপরিকল্পিত এই ব্রিজগুলো নির্মাণের নামে যেনতেন কাজ করে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিল উত্তোলনের জন্য তড়িঘড়ি করে যেখান সেখানে ব্রিজ নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) দুপুরে সড়েজমিনে দেখা যায়, চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের সোনাহারপাড়া গ্রামের খলিশাগাড়ি বিল। গ্রাম থেকে এ বিলে যাতায়াতের রাস্তা নেই বললেই চলে। অথচ বিলের শেষ মাথায় কোনো প্রয়োজন না থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে একটি ব্রিজ।
ব্রিজের উত্তরপাশে নেই যাওয়ার কোনো রাস্তা বা কোনো গ্রাম। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু ও কালভার্ট কর্মসূচীর অধীনে এই ব্রিজটি নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩২ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, গ্রামে ও বিলে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন রাস্তার। কিন্তু সেই রাস্তা না করে উল্টো ব্রিজ করে সরকারি অর্থের অপচয় করা হয়েছে। ব্রিজটি মানুষের কোনো উপকারেই আসছে না।
একই অবস্থা উপজেলার মুলগ্রাম ইউনিয়নের সিংগা খালের ওপর ২১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংযোগ সড়ক না থাকায় কোনো উপকারে আসছে না এই ব্রিজটি।
অপরদিকে, নিমাইচড়া গ্রামে ব্রিজ নির্মাণ হলেও সংযোগ সড়কের বেহাল দশায় কষ্ট বেড়েছে মানুষের। উঁচু খাড়া ব্রিজে উঠতে নামতে নাভিশ্বাস ওঠে বয়স্ক ও শিশুদের। একই চিত্র ফরিদপুর উপজেলার বেড়হাউলিয়া গ্রামের পশ্চিমপাড়া খালের ওপর নির্মিত ব্রিজটি। বর্ষা মৌসুমে সংযোগ সড়ক পানিতে তলিয়ে থাকে। ব্রিজের ওপর বসানো হয়েছে খড়ের পালা।
সদর উপজেলার আতাইকুলা ইউনিয়নের চড়াডাঙ্গা গজারগাড়ী বিলের মধ্যে রাস্তা না থাকলেও একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। সেতু নির্মাণ হওয়ায় এলাকাবাসীর কোনো উপকারেই আসছে না। ভোগান্তির শেষ নেই এই অঞ্চলের কৃষকদের।
পাট, পেঁয়াজ ও ধানের মৌসুমে মৌহিষের গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করতে অসুবিধা হয়। কৃষকরা জানায়, ব্রিজ নির্মাণর সময় মনে করেছিলাম উপকার হবে এখন দেখি দুর্ভোগের শেষ নেই। রাস্তা নির্মাণ না করলে এখান থেকে ব্রিজটি অপসারণ চান তারা।
সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে খালের ওপর একটি সেতু থাকলেও নেই সংযোগ সড়ক। যাতায়াত কিংবা কোনো যানবাহন নিয়ে চলার উপায় নেই। ফসল আনা-নেওয়া করতেও দুর্ভোগের শেষ থাকে না।
ভুক্তভোগী কৃষক মোজাহার ও আবেদ আলী বলেন, ‘ব্রিজ যখন করলই, তাইলে রাস্তাটাও কইরে দেওয়া লাগত। খামাখা এই ব্রিজ দিয়ে কোনো লাভ হয় নাই। ব্রিজে ওঠানামা করতে রাস্তা দরকার। খুব কষ্ট হয়।’
একইভাবে সুজানগর বাজারের গরু হাটের পাশে দুইটা কালভার্ট জাতীয় ব্রিজ করা হয়েছে। নেই কোনো যাতায়াত পথ। শুধু ব্রিজ দুটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে কোনো রাস্তা নেই।
শুধু চাটমোহর, ফরিদপুর বা সুজানগর উপজেলাতেই না, এ রকম অসংখ্য ব্রিজ রয়েছে বিভিন্ন উপজেলার গ্রামীণ জনপথে। এসব ব্রিজ উপকারের পরিবর্তে উল্টো দুর্ভোগ বাড়িয়েছে এলাকাবাসীর। এসব ব্রিজ নির্মাণ কাজও করা হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে। এলাকাবাসী বাঁধা দিলেও তোয়াক্কা করেনি ঠিকাদাররা। ঠিকাদারের সঙ্গে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা যোগসাজশে এসব অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ নির্মাণ করে সরকারি অর্থের লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, কোনো পরিকল্পনা না করেই প্রকল্পের শেষ পর্যায় এসে পকেট ভারী করতেই তড়িঘরি করে অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করা হলে মানুষের কাজে লাগতো এবং সরকারি টাকা অপচয় হতো না।
পাবনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মকর্তা রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এই ব্রিজগুলো অনেক আগে হয়ে থাকতে পারে। বর্ষা মৌসুমে ব্রিজের দু-পাশের মাটির অ্যাপ্রোচ ভেঙে যেতে পারে। তারপরও আপনাদের তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে উপজেলা অফিস থেকে তথ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পাবনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিশ্বাস রাসেল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামীণ জনপদে ব্রিজ নির্মাণ হলেও প্রয়োজনীয় সংযোগ সড়ক নেই এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। তবে এ ধরনের কোনো ব্রিজ থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে সেতু নির্মাণ হয়েছে কিন্তু সংযোগ সড়ক এখনো হয়নি এটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলাম। বর্ষা মৌসুমে ভেঙে যেতে পারে।
রাকিব হাসনাত/এমএসআর