ফেরি চালকদের শেষ কর্মদিবসে নেই আক্ষেপ
পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে বন্ধ হলো বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার পথে ফেরি বিড়ম্বনা। রোববার (২৪ অক্টোবর) সকালে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওদিকে পায়রা নদীর লেবুখালী ফেরিঘাটে চারটি ফেরি চলাচল করছে। চার ফেরিতে এখানকার ৪০ জন স্টাফের শেষ কর্মদিবস দুপুর ২টা পর্যন্ত।
শেষ কর্মদিবসেও ব্যস্ততার কমতি নেই তাদের। বরং গাড়ির চাপ বেশি। মূলত পরিবহনের সঙ্গে অতিথিদের গাড়ি এই চাপ বাড়িয়েছে। তবে ফেরি স্টাফদের শেষ কর্মদিবসে স্মৃতিকাতর হলেও আক্ষেপ নেই তাদের। তবে সেতু উদ্বোধনকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।
১৮ বছর ধরে ফেরির চালক হিসেবে পটুয়াখালী ফেরি বিভাগের লেবুখালী ঘাটে ফেরি চালান জাকির হোসেন। তিনি বলেন, এখানে দীর্ঘ বছরের স্মৃতি। শেষ কর্মদিবস হিসবে একটু খারাপ লাগলেও সেতু উদ্বোধন ভালো লাগছে। এভাবে দেশ এগিয়ে যাক উল্লেখ করে জাকির হোসেন বলেন, দুপুর ২টার পর আর কোনোদিন এই ঘাটে ফেরির হুইসেল বাজবে না। আমাকে বগা ফেরিঘাটে পোস্টিং দিয়েছে। সেখানে হয়তো ৫/৬ দিনের মধ্যে যোগ দেব।
আরেক ফেরিচালক মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ফেরি উদ্বোধন হওয়ার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকার হবে। সরকারকে ধন্যবাদ জানাই জনগণের জন্য এত ভালো কাজ করার জন্য। এখানে নিজের শেষ কর্মদিবস হলেও জনগণের ভোগান্তি লাঘব হয়েছে দেখে আমার খারাপ লাগে না। এখান থেকে ফেরিগুলো বিভিন্ন স্থানে যাবে। এর মধ্যে বেকুটিয়া, মাছুয়া ফেরিঘাটে যাবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ১০টি মেগা প্রকল্পের আওতায় পায়রা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পায়রা সেতুর দৈর্ঘ্য ১৪৭০ মিটার বা ৪ হাজার ৮২০ ফুট এবং প্রস্থ ১৯.৭৬ মিটার। এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল পদ্ধতিতে নির্মিত দেশের দ্বিতীয় সেতু পায়রা। তবে দেশে প্রথমবারের মতো ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম (সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ) চালু করা হয়েছে। যা বজ্রপাত, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অতিরিক্ত মালামালবোঝাই যানবাহন উঠলে সেতুটি ভাইব্রেশন তৈরি করে ক্ষতির শঙ্কা থাকলে সংকেত দেবে।
কর্ণফুলি সেতুর মতোই পায়রায় ২০০ মিটার স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। যা পদ্মা সেতুর স্প্যানের চেয়েও বড়। নদীর মাঝখানে মাত্র একটি পিলার ব্যবহার করা হয়। ১৭ ও ১৮ নম্বর পিলারের পাইল ১৩০ মিটার গভীর, যা দেশের সর্বোচ্চ গভীরতম পাইল। সেতুটি নদীর জলতল থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু। উভয়পারে ৭ কিলোমিটারজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। পিলারের পাশে স্থাপন করা হয় নিরাপত্তা পিলার। সাবস্টেশনের মাধ্যমে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। থাকছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা।
দেশি-বিদেশি ১৩শ'র অধিক শ্রমিক পাঁচ বছর কাজ করে নির্মাণ করেছেন সেতুটি। তবে প্রকল্প অনুমোদন থেকে উদ্বোধন পর্যন্ত ৯ বছরের মতো সময় লেগেছে সেতু চালু হতে। সেতুতে ৩২ টি স্প্যান, ৫৫টি টেস্ট পাইল, ১৬৭টি বক্স গার্ডার, ২৮৬টি পাইল, ৩১টি পাইলক্যাপ, ২২৪টি আই গার্ডার স্থাপন করা হয়েছে। মূলত ২০১২ সালের ৮ মে মাসে একনেকে অনুমোদন পায় পায়রা সেতু প্রকল্প।
বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এরমধ্যে কুয়েত ফান্ড থেকে ৩৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। বাংলাদেশ সরকার জোগাবে ৭৭ কোটি ৩ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোরলেনবিশিষ্ট পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় ২০১৫ সালের ৩১ মে ব্যয় প্রাাক্কলন বাড়িয়ে ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়।
২০১৭ সালের ২০ জুন সংশোধিত ব্যয় প্রাাক্কলন করে হয় ১ হাজার ২৭৮ কোটি ৮২ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। যাতে ব্যয় বেড়ে যায় ৮৬৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংশোধন করে করা হয় ১৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সময় বাড়ানো হয় ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় সেতুর ভৌত কাজ। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’ সেতুটি নির্মাণ করে।
এমএসআর