অর্ধশতাধিক মামলা নিয়ে ছাত্রনেতার মৃত্যু, অভিভাবকশূন্য পরিবার
নামে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক মামলা। নিয়মিত আদালতে হাজিরা। আড়াই মাস আগে মায়ের মৃত্যু। তার আগে বড় ভাইকে হারানোর শোক। সব মিলিয়ে বাড়তি চাপে ছিলেন খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। এই অবস্থায় গত ৩ অক্টোবর মধ্যরাতে ৪২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন এসএম কামাল হোসেন। একমাত্র কর্মক্ষম ও প্রিয় মানুষকে হারিয়ে পরিবার যেমন শোকাহত, তেমনই একজন দায়িত্বশীল ও দলের জন্য নিবেদিত নেতাকে হারিয়ে ব্যথিত দলের নেতাকর্মী ও তার অনুসারীরা। এমনটাই জানিয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা কামালের পরিবার ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা। একই সঙ্গে কামালের রেখে যাওয়া অভিভাবকশূন্য পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলের নেতারা।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, এস এম কামাল হোসেন খুলনার সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজে পড়াশোনার সময় ১৯৯৫ সালে ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। একই বছরে নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৮ সালে সরকারি সুন্দরবন কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও ২০০১ সালে সভাপতি, ২০১০-১৬ সালে খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও ২০১৫ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এসএম কামাল হোসেন ২০১৪ সালে সরকারি বিএল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। তিনি রাজনীতিতে সৎ, সাহসী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় অর্ধশতাধিক রাজতৈতিক মামলা রয়েছে। গত ৩ অক্টোবর রাতে তিনি নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক শিশু কন্যা, এক বোন ও মৃত ভাইয়ের স্ত্রী ও পুত্র সন্তানকে রেখে গেছেন।
কামালের স্ত্রী আসমা সিদ্দীকা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১২ সালে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ২০১৩ সাল থেকেই তাকে রাজনৈতিক কারণে পালিয়ে বেড়াতে দেখেছি। বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় থাকতে হতো। তিনি (কামাল) জানিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে ৭২টি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। ছুটি বাদে প্রায় সব দিনই আদালতে হাজিরা দিতে হতো তাকে। এছাড়াও পরিবার থেকে বড় ভাই চলে যাওয়ায় শোকের মধ্যে ছিলেন।
তিনি বলেন, আমি দেখেছি আমার শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে গেটের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে থাকতেন। কেউ শব্দ করলেই তিনি ‘কে’ বলে উঠতেন। তার মনের মধ্যে চিন্তা কাজ করতো এই মনে হয় পুলিশ আসছে, কামালকে ধরতে আসতেছে। আড়াই মাস আগে গত ১৬ জুলাই মা চলে যাওয়ার পর কামালের মন অনেক নরম হয়ে যায়। একেতো রাজনৈতিক টেনশন, অন্যদিকে পরিবার থেকে বড় ভাই ও মা চলে গেল।
আসমা সিদ্দীকা বলেন, যে রাতে তিনি (কামাল) মারা যান সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে গল্প করেছিলেন। তার মধ্যে কোনো অসুস্থতা ছিল না। খারাপ লাগছে-এমনটাও বলেননি। মামলা ও পারিবারিক শোকে তিনি সব সময় চিন্তিত থাকতেন।
মা ও দুই ভাইকে হারিয়ে কামালের একমাত্র বোন তৌফাতুন্নেছা বলেন, কামাল আমার অনেক আদরের ছোট ভাই। মা ও আরেক ভাই চলে যাওয়ার পর দুই ভাইবোন গল্প করতাম। কামাল আমাকে বলতো- ‘আমার অনেক পেশার, রাতে ঘুম হয় না।’ আমি বলতাম- এতো চিন্তা করিস কেন? সে বলতো- ‘কী করবো, আমার নামে অনেকগুলো মামলা। মামলা থেকে কবে বের হবো?’ আল্লাহ তাকে ডাক দিয়েছে চলে গেছে। কিন্তু মামলার দুশ্চিন্তা ছিল তার।
তিনি বলেন, কোথাও কিছু হলেই তার নামে মামলা। এমনকি জেলের ভেতরে থাকতেও বাহিরে কেউ কিছু করলে কামালের নামে মামলা হতো। এখন আল্লাহর কাছে দোয়া চাই। তার একটি শিশু কন্যা রয়েছে। আমার ছোট তিনটা ভাইপো রয়েছে। তাদের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
এসএম কামালকে হারিয়ে শুধু পরিবারই নয়, শোকাহত তার রাজনৈতিক সহকর্মী, নেতা ও অনুসারীরাও। অভিভাবকশূন্য পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা।
খুলনা মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হাসান মাহমুদ বলেন, ২০০৭ সালে কামাল ভাইয়ের হাত ধরে আমার রাজনীতিতে প্রবেশ করা। তিনি একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ ছিলেন। সব সময় ন্যায়ের পথে থাকতেন। তিনি এইভাবে চলে যাওয়াতে আমিসহ তার অনেক অনুসারী ব্যথিত। তার চলে যাওয়া এখনও মেনে নিতে পারছি না। আমি মনে করি তিনি এখনও আমাদের মাঝে রয়েছেন।
খুলনা মহানগর বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক সামসুজ্জামান চঞ্চল বলেন, খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন আমার সহযোদ্ধা ও বন্ধু ছিল। আমরা একসঙ্গেই সুন্দরবন কলেজ থেকে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করি। মেধা, কর্মদক্ষতা ও সাংগঠনিক শক্তি সব মিলিয়ে ছাত্র সমাজকে কীভাবে একত্রিত করতে হবে তার মধ্যে সেইসব গুণাবলী ছিল। আন্দোলনে তার অগ্রণী ভূমিকার কারণে পর পর বিভিন্ন পদ পেয়েছিল। সর্বশেষ পদ না পেলেও সব আন্দোলন সংগ্রামে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
খুলনা মহানগর বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী মোল্লা গোলাম মওলা বলেন, একজন ছাত্রনেতার যে গুণাবলী থাকা দরকার তার সবই কামালের ছিল। বর্তমানে এই ধরনের নেতার খুবই অভাব। খুলনা শহরে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে যতোগুলো মামলা রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক মামলার আসামি ছিল কামাল। অর্ধশতাধিক মামলার আসামি ছিল কামাল। ছুটির দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হতো। হাজিরা ছাড়া অন্য কোনো কাজ সে করতে পারতো না।
তিনি বলেন, আইনজীবী হিসেবে সে আমাকে বলতো- ‘ভাই কী করবো মামলার হাজিরার কারণে সংসার-ধর্ম সবই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ তবুও সে আমার কথা মতো মামলার হাজিরা দিতো। তার একটা ছোট কন্যা সন্তান আছে। তার দেখাশোনার দায়িত্বসহ আশা করি মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ তার পরিবারের পাশে থাকবেন, খোঁজখবর নেবেন এবং বিপদ-আপদে পাশে থাকবেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরীক্ষিত কর্মী এসএম কামাল হোসেনকে আমরা হারিয়েছি। সে রাজনৈতিক ৭২টি বিভক্ত মামলায় বিচারের মুখোমুখি ছিল। কারা নির্যাতন, পুলিশি নির্যাতন ভোগ করেছে। দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে তাকে রাত কাটাতে হয়েছে। এমন একজন রাজনৈতিক পরীক্ষিত কর্মী হারিয়ে বিএনপিতে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, কামালের রাজনৈতিক কর্মী ও সহযোদ্ধারা কামালকে হারিয়ে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছে। বেদনাহত বিএনপি পরিবারের সদস্যরা কামালের মতো রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বেই দলগঠন ও আগামী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করতে চেয়েছিলেন। তাকে হারিয়ে আমরা একটা শূন্যতায় ভুগছি। তাকে হারানোর বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করে আমরা আগামীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয় নিশ্চিত করবো ইনশাআল্লাহ।
সাবেক ছাত্রনেতা কামালের পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, কামালের পরিবার আজ অভিভাবকশূন্য। সে তার বাবা, মা ও ভাইকে হারিয়েছে। তার ভাই নির্মমভাবে খুন হয়েছিল। সর্বশেষ কামাল আকস্মিকভাবে বিদায় নিয়েছে। তার অভিভাবকশূন্য পরিবার দেখার দায়িত্ব আমাদের। আমরা তার পরিবারের পাশে থেকে পরিবারকে আগলে রেখে আগামীতে পথ চলব।
আরএআর