হৃদরোগ বিষয়ে করণীয় জানালেন চিকিৎসক
দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে হৃদরোগী সংখ্যা। বর্তমানে শুধু বয়স্কদেরই নয়, শিশু-কিশোররাও আক্রান্ত হচ্ছে এ রোগে। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই এক বছরে শুধু ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ২৮ হাজার রোগী।
তাদের মধ্যে মারা গেছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এ ছাড়া হাসপাতালের হৃদরোগ বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা নেয় ৭০ থেকে ১০০ জন রোগী, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
হৃদরোগের নানা বিষয় এবং এ রোগ থেকে বাঁচতে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. শিবলী সাদেক শাকিল।
হৃদরোগ কী
হৃৎপিণ্ড-সংক্রান্ত সব রোগই হৃদরোগের মধ্যে পড়ে। মূলত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ দেখা দেয়। জন্মগত হৃদরোগ আছে, বর্ধনশীল সময়ে কিছু হৃদরোগ দেখা দেয় এবং সবচেয়ে বড় যে অংশটা বর্তমানে বেশি দেখা যায়, সেটা হচ্ছে, হৃদরোগের রক্তনালি-সংক্রান্ত রোগ। যেটা হার্ট অ্যাটাক হিসেবে আমাদের চোখে আসে।
এর মধ্যে হার্ট অ্যাটাক এবং তৎপরবর্তী সময়ে যে হৃদযন্ত্রের কাজই হচ্ছে রক্ত সারা শরীরে পাম্প করে দেওয়া। এই রক্ত দিয়েই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গ, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে সবকিছুই ঠিকমতো চলে। অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড সারা শরীরের একটি কেন্দ্রবিন্দু এবং তা ইঞ্জিনের মতো কাজ করে। এটির কর্মক্ষমতা যদি কমে আসে অর্থাৎ একটা হার্ট অ্যাটাকের পর এর পাম্পিং ক্ষমতা যদি কমে আসে, তাহলে ক্রমেই সব অঙ্গপ্রতঙ্গ কর্মে ব্যাহত হয়।
যাদের হৃদরোগ হয়, কেন হয়
হার্ট অ্যাটাক মূলত প্রাপ্তবয়সে হয়। আগে হয়তো একটা ধারণা ছিল যে ৪০-ঊর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদেরই হার্ট ফেইলরের মতো সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, কম বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যেও যেমন ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। আবার আগে ধারণা ছিল যে মেয়েদের বা নারীদের এই রোগটা কম হয়। কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে প্রায় সমানতালে নারী-পুরুষ বা ছেলে-মেয়েদের, এমনকি কম বয়সীদেও হচ্ছে।
বেশ কিছু গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের যে জেনেটিকস, সেটাতে খুব অল্প বয়সে হৃদরোগের আশঙ্কা ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের তুলনায় অনেক বেশি। তার মানে আমাদের দেশে যে জনসমষ্টি, তার মধ্যে কিছু জন্মগত ও জিনগত কারণ আছে। তা ছাড়া আমাদের যে প্রত্যাহিক অভ্যাস যেমন : আমাদের কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস কম, শাকসবজি ও ফল খাওয়ার অভ্যাস কম, ধূমপানের অভ্যাস বেশি বা পরিবেশে ধুলাবালু ও ধোঁয়া বেশি। সব মিলিয়েই এখন ধারণার চেয়ে বা প্রত্যাশার চেয়ে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
হৃদরোগ থেকে বাঁচার উপায়
একবার হৃদরোগ মানে হচ্ছে হার্টের একটা দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়া। ভবিষ্যতে যদি ঠিকভাবে চিকিৎসা না চলে, তাহলে হৃৎপিণ্ড আস্তে আস্তে ফেইলরের দিকে চলে যাবে। বিভিন্ন ধাপে যেসব চিকিৎসা আছে, সেই চিকিৎসাটা প্রায় সারাজীবনের চিকিৎসা এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল চিকিৎসাও বটে।
প্রতিবছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালিত হয়। এটি প্রতিপালিত হওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা। এই প্রতিরোধ সম্ভব যদি জনসচেতনতা সৃষ্টি ও জীবনযাপনের পরিবর্তন করা যায়। অর্থাৎ যে রোগ হলে সারাজীবনের চিকিৎসা লাগবে, চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং যে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, এই রোগকে প্রতিরোধই আমাদের মূল লক্ষ্য।
হৃদরোগ প্রতিরোধে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সচেতনতা ও জীবনাচার এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আনা। মাংস-জাতীয় খাবার, তেল-জাতীয় খাবার কম খাওয়া এবং শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খাওয়া, ধূমপান পরিত্যাগ করা, প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটা, কায়িক পরিশ্রম করা, কায়িম পরিশ্রমের অভ্যাসে থাকা, হাসি-খুশি থাকা, ভালো থাকা এবং দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা।
যদি হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায় অর্থাৎ হৃদরোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, তাহলে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভূমিকা তো বটেই, চিকিৎসা ব্যয়ের যে কষ্ট এবং চিকিৎসার যে জটিলতা, সবকিছু থেকেই আমরা রক্ষা পেতে পারি।
এনএ