অপরাধীদের আতঙ্ক ছিলেন এএসআই পেয়ারুল
মাঝরাতে মাদকসেবীকে ধরতে অভিযান চালানো হয়। সেই অভিযানে পলাশ রহমান নামে এক মাদকসেবীকে আটক করেন পুলিশ সদস্যরা। সেখানে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পেয়ারুল ইসলামের বুকে ও পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন পলাশ। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত্যুর কাছে হার মানেন সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা পেয়ারুল। ত্রিশোর্ধ্ব এই পুলিশ কর্মকর্তার অকাল মৃত্যুতে শোকাতুর পুলিশ বিভাগ।
শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বেলা সোয়া ১১টার দিকে এএসআই পেয়ারুল ইসলামের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নজনের শোকবার্তায় ভাসতে থাকে পেয়ারুলের ছবি। অনেকেই তার মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত মাদকসেবীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন। পুলিশ বিভাগের অনেকেই পেয়ারুলের সাহসী চরিত্র তুলে ধরে তাকে বাস্তব জীবনের নায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
দায়িত্ব পালন ও সাহসিকতায় অবিচল থাকা এএসআই পেয়ারুল ইসলাম অপরাধীদের আতঙ্ক ছিলেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। তিনি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা পেয়ারুল ইসলামের মৃত্যুতে তার নিজের ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন- একজন সত্যিকারের নায়ককে হারাল বাংলাদেশ পুলিশ, আমি হারালাম একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও প্রিয় সহকর্মীকে।
ফারুক আহমেদের ভাষ্য, এএসআই পেয়ারুল অত্যন্ত সাহসী, দক্ষ, যোগ্য, সৎ, নিষ্ঠাবান ও পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। জনসাধারণকে আইনি সেবা দিতে তিনি সবসময় অত্যন্ত সক্রিয় ও নিবেদিত ছিলেন। সকল সংকীর্ণতা ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে এএসআই পেয়ারুল সর্বদা জনসাধারণকে ন্যায়সঙ্গত সেবা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। মানুষের জান-মাল রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়কে রুখে দিত তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। অন্যায় ও অপরাধীদের সঙ্গে এএসআই পেয়ারুল কখনোই আপস করতেন না। অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তার অনড় ও অবিচল অবস্থানের কারণে জনগণ ও পুলিশের মাঝে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। পুরো রংপুর মহানগরী জুড়েই তার ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল।
তিনি আরও লিখেছেন, আমরা সিনেমা ও নাটকে নায়ককে দেখি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এসআই পেয়ারুল তেমনি বাস্তব জীবনের একজন নায়ক ছিলেন। অপরাধীদের কাছে এএসআই পিয়ারুল ছিলেন আতঙ্কের নাম। পরম করুণাময় মহান আল্লাহর রহমতে তিনি দেখতে যেমন সুন্দর ছিলেন, তেমনিভাবে তার কাজকর্ম, মন-মানসিকতা, মেধা, দক্ষতা সবকিছুই ছিল অত্যন্ত সুন্দর। তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর, সুনিপুণ এবং মনোমুগ্ধকর। তিনি ছিলেন বঞ্চিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের পক্ষে একজন সত্যিকারের নায়ক। বাংলাদেশ পুলিশ তাকে হারিয়ে একজন সম্পদকে হারাল।
রংপুর মহানগরীর কোতোয়ালি থানা পুলিশের পরিদর্শক (এসআই) মজনু মিয়া তার ফেসবুক আইডিতে (মিসির আলী মিসির) লিখেছেন- জীবন আহারে জীবন। কত দ্রুত ছন্দের পতন ঘটে। একটা জীবনের, একটা পরিবারের। গভীর রাতে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেওয়া মানুষটার কথা ভাবছি আর তার ছোট্ট বাবুদের। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় নিজেকে যত্নে রাখা, আগলে রাখা একজন স্মার্ট অফিসার ছিলেন পেয়ারুল ইসলাম। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।
এ রকম অনেকেই পেয়ারুল ইসলামকে হারানোর শোকে কাতর হয়ে ফেসবুকে লিখেছেন বেদনার কথা। কেউ কেউ পেয়ারুলের বিভিন্ন সময়ের ছবি পোস্ট করেছেন। পুলিশের পাশাপাশি রংপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা পেয়ারুল ইসলামের অকাল মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
এদিকে পেয়ারুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন নগরীর হারাগাছ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত আলী সরকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে হারাগাছের সিগারেট কোম্পানি মোড় এলাকায় মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। সেখানে পারভেজ রহমান পলাশ নামে এক মাদকসেবীর হাতে ছুরিকাঘাতের শিকার হন এএসআই পেয়ারুল ইসলাম। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
উল্লেখ্য, পেয়ারুল ইসলাম কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চন্দ্রপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা আব্দুর রহমান মিন্টু স্থানীয় চন্দ্রপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে যোগ দেন পেয়ারুল ইসলাম। পরে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে এএসআই পদে যোগদান করেন। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগদানের পর তিনি সাফল্যের সঙ্গে মাহিগঞ্জ থানা, গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এবং সর্বশেষ হারাগাছ থানায় কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীসহ দুই ছেলে সন্তান রেখে গেছেন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর