প্রশিক্ষণের ৫০০ টাকা থেকে শত কোটি টাকার মালিক বাবুল
হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া বাবুল আখতারের বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার ওপর আবার শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। এ কারণে তার দ্বারা শক্ত বা ভারী কোনো কাজ করাও সম্ভব ছিল না। তবু সারাক্ষণ হন্তদন্ত থাকতেন কীভাবে আয়রোজগার করবেন। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকার নয়। তিনিও আর দশজনের মতোই উদ্যোগী হলেন। পরে পরিচিত এক চিকিৎসকের পরামর্শে আগ্রহী হলেন মাশরুম চাষে।
শত প্রতিকূলতার মধ্যে প্রাথমিক পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি আর পেরোতে পারেননি তিনি। অথচ অদম্য উৎসাহ ও ইচ্ছাশক্তির দ্বারা মাশরুম চাষ করেই শূন্য থেকে আজ প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন থেকে ৮০ প্রকারের ওষুধ তৈরির অনুমোদনও পেয়েছে তারই হাতে গড়া ‘ড্রিম মাশরুম সেন্টার’।
এমন একজন যুবক উদ্যোক্তার সফলতার গল্প যেন কোনো কল্পকাহিনিকেও হার মানায়। কিন্তু এটা যে আজ বাস্তব কাহিনি, তা এই নায়কের বাড়ি মাগুরার সদর উপজেলার ৭নং মঘী ইউনিয়নের বড়খড়ী গ্রামে গেলেই বোঝা যায়। গল্পের শুরুর কথা ও সফলতার কথা ও বর্তমানের কথা জানতে ঢাকা পোস্ট হাজির তার স্বপ্নের আঙিনায়।
২০১৮ সালে সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় যুব ও জাতীয় কৃষিপদক পান বাবুল আখতার। বর্তমানে তিন একর জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন ‘ড্রিম মাশরুম সেন্টার’ নামের একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। এখানে একদিকে মাশরুম চাষ হচ্ছে, অন্যদিকে ল্যাব ও কারখানায় গবেষণারের মাধ্যমে মাশরুম প্রক্রিয়াজাত করে তা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে।
বর্তমানে সারা দেশে ৬৪টি শোরুম ও ১ হাজার মার্কেটিং প্রমোশন অফিসার কাজ করছেন বাবুল আখতারের অধীনে। বিশাল এই কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে দেশব্যাপী মাশরুম বিপণনের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শুধু দেশে নয়, পাশের দেশ ভারতেও তার উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাশরুম রফতানি করা হচ্ছে। আজ তার গ্রামের কয়েক শ পরিবার মাশরুম চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কারণ তারাও বাবুলের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর তাতেই বড়খড়ী গ্রামটি এখন মাশরুম ভিলেজ নামেই খ্যাতি পেয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ড্রিম মাশরুম সেন্টারের ফ্লোরে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম। ল্যাব ও কারখানায় কাজ করছেন একদল কর্মী। সেখানে নির্দেশনা দিচ্ছেন বাবুল। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মাশরুম রয়েছে তার এখানে, যা ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কার্যকরী।
বাবুল আখতারের গল্পের শুরু ২০০৭ সালে। একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, মাশরুম চাষ করে অসহায় ও প্রতিবন্ধী যুবকেরা স্বাবলম্বী হতে পারেন। এতে তিনি উদ্বুদ্ধ হন এবং যশোরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পাওয়া ৫০০ টাকা ও ১০০ মাশরুমের বীজ দিয়ে পথচলা তার। পরের বছর ২০০৮ সালে ঢাকার সাভার থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুনভাবে এ চাষে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আর। প্রথম দিকে শুধু মাশরুম চাষ করে তা বিক্রি করতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে মাশরুমের বীজ উৎপাদন শুরু করেন। এরপর তিনি এলাকার কৃষকদের তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এ কাজে তিনি এলাকার প্রায় এক হাজার মানুষকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরও সফল করে তোলেন। তারপর এলাকায় গড়ে তোলেন মাশরুম খামার ‘ড্রিম মাশরুম সেন্টার’।
বাবুল আখতার ঢাকা পোস্টকে জানান, শিল্প উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণের পর তিনি ব্যাপকভাবে গ্রামে খামারি তৈরি করার কাজে হাত দেন। ২০১২-১৩ সালে তার খামারে ব্যাপকভাবে ওয়েস্টার মাশরুমের চাষ শুরু করেন। এরপর নিজ গ্রামে খামার বৃদ্ধি করে সেখানে মাশরুম ভিলেজ সৃষ্টি করেন। এ কাজে এলাকার কৃষকদের সম্পৃক্ত করেন তিনি।
২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তিনি উৎপাদিত মাশরুম বিপণনের জন্য তিন শতাধিক কর্মী নিয়োগ করেন। ২০১৭ সালে তিনি বিশ্বের ১ নম্বর গ্যানো ডারমা মাশরুম পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। এরপর তা দেশব্যাপী প্রসারের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। এতদিন বুঝতে পারেননি সফলতার সিঁড়ি কতদূর বেয়েছেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় যুব পদক এবং জাতীয় কৃষিপদক পান, তখন তিনি বুঝলেন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।
এবার নিলেন আরও বড় চিন্তা, সাহসী উদ্যোগ। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মাশরুম প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করতে ল্যাব স্থাপন এবং কারখানা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। তিন একর জমির ওপর গড়ে তোলেন ড্রিম মাশরুম সেন্টার। বর্তমানে ১২০ জন কর্মী কাজ করছেন সেখানে।
উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়ে বাবুল জানান, এ পর্যন্ত ৩৫টি ব্যাচকে তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং দিয়েছেন। প্রতি ব্যাচে ৬৪ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নেন। তা ছাড়া দেশব্যাপী প্রায় ৪০ হাজার উদ্যোক্তাকে তিনি মাশরুম চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন নিজে মাশরুম চাষ কমিয়ে দিয়ে খামারিদের কাছ থেকে মাশরুম কিনে তা নিজের সেন্টারে প্রসেস করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন মাসে তিনি ৮ থেকে ১০ টন মাশরুম তিনি কিনছেন। যা দিয়ে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগের মহৌষধ তৈরি করছেন। তাই সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক ৮০ প্রকারের ইউনানি বা হারবাল জাতীয় ওষুধ তৈরির জন্য তিনি অনুমোদন পেয়েছেন। এর মধ্যে গ্যানোডার্মা হেলথ জুস, গ্যানো সুপার ট্যাবলেট, গ্যানো ওম্যান হেলথ জুস অন্যতম। তা ছাড়া মাশরুম থেকে সরাসরি আরও ২০ প্রকারের ওষুধ তিনি তৈরির পর্যায়ে চলে এসেছেন।
সুখমিশ্রিত হাসি দিয়ে বাবুল আখতার বলেন, একদিন ভাবতাম আমার ভবিষ্যৎ কীভাবে চলবে। কিন্তু আজ ভাবি, আমার দ্বারা প্রায় শত কোটি টাকার প্রকল্প দাঁড়িয়েছে। শুধু সেন্টারটি সেটআপ করতেই প্রায় ১৮ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে বলে তিনি জানান। ‘ভারতের মার্কেটে আমি প্রোডাক্ট পাঠাচ্ছি। এখন আমার টার্গেট ইউরোপের মার্কেট ধরা’ এমন উচ্চমার্গীয় ভাবনা বাবুল এবার ভাবতেই পারেন।
কথা হয় বাবুল আখতারের ড্রিম মাশরুম সেন্টারে কাজ করা কয়েকজনের সঙ্গে। সেখানের ল্যাব টেকনিশিয়ান লিপি দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চার বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। বর্তমানে এখানে অনেক পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো বাইরের দেশে পাঠানো হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগে আমি হামদার্দ ল্যাবরেটরিজে কাজ করেছি। তবে বাবুল আখতার সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। সে কারণে এখানে কাজে যোগ দিয়েছি।
প্রতিবেশী সবিতা রানী বলেন, বাবুল আক্তারের হাত ধরেই আজ আমাদের মতো অনেক বেকার ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল লোক স্বাবলম্বী হয়েছি। এখন আমরা পরিবার নিয়ে ভালো আছি।
কৃষি বিভাগ মাগুরা অঞ্চলের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে কীভাবে সফলতা অর্জন করা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন বড়খড়ী গ্রামের বাবুল আখতার। তিনি বর্তমান সমাজে বেকার যুবকদের জন্য অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত ও আদর্শ বলে আমি মনে করি।
মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবুল আখতার মাশরুম চাষ করে বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। তা ছাড়া তিনি অনেক উদ্যোক্তাও তৈরি করে যাচ্ছেন। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। আমি তার এই অভাবনীয় কাজের প্রশংসা করি।
এনএ