র্যাবের গুলিতে পা হারানো সেই লিমনের বিয়ে আজ
১০ বছর আগে র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছিলেন লিমন হোসেন। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। সে সময় লিমনের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় র্যাবের অভিযান। সেই লিমনের আজ শুক্রবার (০৩ সেপ্টেম্বর) বিয়ে। সকাল পৌনে ৮টায় কনের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন। কনে রাবেয়া বশরী যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌরসভার সরখোলা গ্রামের নুরবাগ এলাকার টিটু মোল্লা ও জ্যোস্না বেগমের মেয়ে।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেন ও হোসনেয়ারা বেগমের ছেলে লিমন হোসেন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। এরপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গণবিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে শিক্ষা সহকারী হিসেবে যুক্ত হন। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১ আগস্ট প্রভাষক হিসেবে পদায়ন হয় তার।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে পা হারায় লিমন। ওই সময় সে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ রাতেই লিমনসহ ৯ জনের নামে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা দায়ের করেন র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান। একটি অস্ত্র আইনে এবং অপরটি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে। দুটি মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন লিমন।
২৪ মার্চ লিমনকে রাজাপুর হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। ২৫ মার্চ লিমনকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে ২৭ মার্চ চিকিৎসকরা লিমনের বাম পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলেন।
৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোয় লিমনকে নিয়ে একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওইদিনই পঙ্গু হাসপাতালে লিমনকে দেখতে যান তৎকালীন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।
১০ এপ্রিল লিমনের মা হোসনেয়ারা বেগম বাদী হয়ে র্যাবের ৬ সদস্যর বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লিমনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি নালিশি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান, কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহল্লাদ চন্দ্র ও সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাসকে। আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লিমনের মায়ের অভিযোগ রাজাপুর থানাকে এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করার নির্দেশ দেন।
পুলিশ অনেক সময় ক্ষেপণের পর ২৬ এপ্রিল ৬ র্যাব সদস্যের নামে রাজাপুর থানায় মামলা রেকর্ড করে। মামলা রেকর্ডের আগে ২৪ এপ্রিল অস্ত্র আইনের মামলায় লিমনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৩ মে হাইকোর্ট লিমনের জামিন মঞ্জুর করেন।
লিমন হত্যাচেষ্টা মামলায় রাজাপুর থানা পুলিশ ১৮ আগস্ট ২০১২ সালে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ৩০ আগস্ট লিমনের মা নারাজি দাখিল করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে নারাজি খারিজ করে দেন আদালত। নারাজি খারিজের বিরুদ্ধে লিমনের মা ১৮ মার্চ জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে লিমনের নামে দায়ের করা অস্ত্র মামলা ২৯ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর সরকারি কাজে বাধা দানের মামলা ১৬ অক্টোবর ২০১৪ সালে প্রত্যাহার করে নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।
লিমনের মায়ের দায়ের করা রিভিশন ৪২তম শুনানির দিন ১ এপ্রিল ২০১৮ মঞ্জুর করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। রিভিশন মঞ্জুরের পর ২২ এপ্রিল ২০১৮ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামীম রেজা, লিমন হত্যাচেষ্টা মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। বর্তমানে পিবিআইর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে লিমনের মায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে মায়ের সঙ্গে গরু আনতে গিয়েছিলেন লিমন হোসেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন র্যাব সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। পরে ডিএডি লুৎফর রহমান লিমনের শার্টের কলার ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন। তখন লিমন তার পা ধরে কেঁদে বলেন, ‘আমি সন্ত্রাসী না, আমি স্টুডেন্ট। পাশের ইটভাটায় আমি কাজ করি। খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাই।’ এরপর লুৎফর রহমান লিমনের মাথায় গুলি না করে পায়ে গুলি করেন।
লিমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও প্রথম আলোর অবদান কখনো ভুলতে পারব না। সাংবাদিক আককাস সিকদারের কথাও ভোলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বাবা-মাকে সবসময় সাহস দিতাম, আমাদের সুদিন আসবে, আমরা ঘুরে দাঁড়াব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বেন বলেই আইন বিষয়ে পড়েছেন বলে জানান লিমন।
ইসমাঈল হোসাঈন/এসপি