নারী কাজি হতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান আয়েশা
দেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নারী বিবাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) পদে অসীন হতে পারবেন না, আদালতের এমন রায় প্রকাশের পর ওই মামলার রিটকারী আয়েশা সিদ্দিকা আবারও উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। নারী বিবাহ রেজিস্ট্রার হতে শেষ পর্যন্ত তিনি আইনি লড়াইসহ প্রধানমন্ত্রীরও সহযোগিতা চান।
আয়েশা সিদ্দিকার বাড়ি দিনাজপুরে ফুলবাড়ি পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাটা বাড়ি এলাকায়। তার স্বামীর নাম সোলায়মান মন্ডল। তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকেন। স্বামীর সঙ্গে বাবার রেখে যাওয়া সিদ্দিকীয় হোমিও হল নামের একটি চিকিৎসালয়ে সময় দেন তিনি।
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্রয়োজন নেই। আদালত এক পক্ষে রায় দিয়েছেন। আদালত যে সমস্যার কথা বলছেন, এটা অযৌক্তিক।
আয়েশা সিদ্দিকা
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে নিজ বাসায় কথা হয় আয়েশা সিদ্দিকাসহ তার পরিবারের সঙ্গে। কথায় তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে শহরের দারুস্ সুন্নাহ সিদ্দিকীয় ফাজিল (ডিগ্রি) কেন্দ্রীয় মাদ্রসা থেকে দাখিল, ’৯৮ সালে আলিম ও ২০০০ সালে ফাজিল পাস করেন। দাখিল পাস করার পর বিয়ে করেন তিনি। আয়েশার বাবা ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে তার বাবা মারা যান। সেই থেকে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্দিকীয় হোমিও হল চিকিৎসালয়ে সময় দেন।
আয়েশা বলেন, ২০০৯ সালে ফুলবাড়ি পৌরসভা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হলে প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে বিবাহ রেজিস্ট্রার প্রয়োজন হয়। এর আগে পৌরসভাটি তৃতীয় শ্রেণিতে থাকায় একজন বিবাহ রেজিস্ট্রার দিয়েই কাজ চলছিল। সেই সময় নিয়ম পরিবর্তন হওয়ার কারণে ৪, ৫, ৬ ও ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিবাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স প্রদানের নিমিত্তে বিধি-৬(২) ধারা মোতাবেক দরখাস্ত আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। সেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ওই সালের মে মাসে ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য আয়েশা সিদ্দিকা, আলেয়া খাতুন ও নাজমুন নাহার নামের তিনজন নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার জন্য আবেদন করেন।
পরবর্তী সময়ে সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ পাঁচ সদস্যদের একটি সুপারিশ কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটিতে ছিলেন সাবেক গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, তৎকালীন ফুলবাড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার এবং পৌর মেয়র। কমিটি আয়েশা সিদ্দিকাকে প্রথম প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠায়।
একই সময় ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য সাখাওয়াত হোসেন নামের এক ব্যক্তি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকেও ওই সুপারিশ কমিটি অনুমোদন দেয়। পরে সাখাওয়াত হোসেনকে নিকাহ রেজিস্ট্রার করা হলেও আয়েশা সিদ্দিকাকে বাদ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে নারী বা পুরুষ কোনোটিই উল্লেখ ছিল না।
এ বিষয়ে আয়েশা সিদ্দিকার স্বামী সোলায়মান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আয়েশা সিদ্দিকাকে বিবাহ রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ না দেওয়ার কারণে সেই নিয়োগের বিপক্ষে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্টের দারস্ত হন তারা। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নারী বিবাহ রেজিস্ট্রার পদে আসীন হতে পারবেন না, এমন রায় প্রদান করেন আদালত।
সেই সময় আয়েশা সিদ্দিকার পক্ষে হাইকোটের আইনজীবী ছিলেন হুমায়ন কবির। পরে তিনি (আয়েশা) রায়ের পর একই বছর মার্চ মাসে রায়ের বিপক্ষে আবারও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। মামলাটি চলমান থাকলেও ২০২০ সালের ২৬ মার্চের রায়ের পূর্ণাজ্ঞ কপি প্রকাশ হয় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি। বর্তমানে মামলাটি পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজা সহায়তা করছেন।
আয়েশা সিদ্দিকার বিরুদ্ধে রায় ইনজাসটিস হয়েছে। এই রায়ে অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ মহিলা যদি ধর্ম শিক্ষক থাকতে পারেন, মহিলা প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিচারপতি থাকতে পারেন, তাহলে মহিলা কাজি থাকতে পারবে না কেন? কাজি কিন্তু বিবাহ পড়ান না। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করেন।
সাখাওয়াত হোসেন, নিকাহ রেজিস্ট্রার
মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন ১৯৭৪ সনের ৫২ নম্বর আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘বিবাহের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্রয়োজন নাই। যদিও তৎকর্তৃক উক্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইতে বাধ্য নহে। ধর্মীয়ভাবে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পরই রেজিস্ট্রেশনের প্রশ্ন আসে।’
এ ছাড়াও ধারা-৫-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্রয়োজন নাই। অন্য যে কেহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিতে পারেন।’
সেই সময় ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত বিবাহ রেজিস্ট্রার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০১২ সালের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সুপারিশ বোর্ড সুপারিশ করে আমাকে এবং আয়েশা সিদ্দিকাকে। সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে এবং আয়েশা সিদ্দিকাকে ডিও দেন। এরপর আমাকে নিয়োগ দিলেও আয়েশাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
সাখাওয়াত আরও বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বলছি, আয়েশা সিদ্দিকার বিরুদ্ধে রায় ইনজাসটিস হয়েছে। এই রায়ে অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন। কারণ মহিলা যদি ধর্ম শিক্ষক থাকতে পারেন, মহিলা প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিচারপতি থাকতে পারেন, তাহলে মহিলা কাজি থাকতে পারবে না কেন? কাজি কিন্তু বিবাহ পড়ান না। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করেন।
বিবাহের জন্য ইজাব, কবুল, সাক্ষী―এ তিনটি হলো শর্ত। এখানে ইমামের কোনো পাঠ নেই। রেজিস্ট্রারের কোনো পাঠ নেই। বিয়েতে খুতবা পড়া সুন্নত, পাঠ করলেও হবে, না করলেও বিবাহ সম্পূর্ণ হবে বলেও জানান তিনি।
পৌরসভার ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার সাইফুল ইসলাম বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রার সম্পাদনের জন্য মসজিদে প্রবেশ বাধ্যতামূলক নয়। বিয়ে পড়ার সঙ্গে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও বলেন, একই সময় যদি চারটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, তাহলে একজন কাজি যেকোনো একটি বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। অন্য বিয়েগুলো ইমাম দারা পড়িয়ে নিতে হবে। পরে কাজি গিয়ে সেই বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করবেন। এটাই নিয়ম।
মায়ের বিবাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার পক্ষে আয়েশার মেয়ে উম্মে হাবিবা জানান, আমার মা নারী সমাজের ও নারীর অধিকার আদায়ের জন্য যে যুদ্ধ করছেন, আমি চাই তিনি যেন সঠিক রায় পান। বেগম রোকেয়া যেমন নারীর অধিকার রক্ষা করেছেন, আমার মাও যেন সেই অধিকার রক্ষা করতে পারে।
জানতে চাইলে ফুলবাড়ি উপজেলা বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার মোমেনুল ইসলাম বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বলতে পারবেন।
জানতে চাইলে ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিয়াজ উদ্দিন বলেন, একজন মানুষের অধিকার রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দারস্ত হওয়া। তিনিও সেখানে গিয়েছেন। আদালত তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। এই বিষয়ে আমার বিস্তারিত জানা নেই।
এনএ