পাটের মণ ২৩০০ টাকা, তবু কাটছেন না কৃষকরা
চুয়াডাঙ্গা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পাটের ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৫২৭ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩ হাজার ৭৯৭ হেক্টর বেশি। চুয়াডাঙ্গায় পাটের বড় সমস্যা পানির অভাব। পানির অভাবে ভালোভাবে পাট পচাতে পারেন না কৃষকরা। এ মুহূর্তে কর্তন শুরু হলেও অধিকাংশ কৃষক এখনো পাট কাটা শুরু করেননি।
হাতে গোনা কয়েকজন কৃষক পাট জাগ দেওয়ার জন্য পানি পাচ্ছেন না। অনেক কৃষকের কাটা পাট ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবার চুয়াডাঙ্গার নিচু এলাকাগুলো রয়েছে পানিশূন্য। কেউ কেউ শ্যালো মেশিন দিয়ে পানির ব্যবস্থা করলেও তাতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। নিশ্চিত লাভ জেনেও পানির অভাবে কৃষকের স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গার মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। প্রতিবছর এ জেলার কৃষকরা অন্য ফসলের মতোই পাট চাষ করে থাকেন। গত বছর পাটের বাজারদর ভালো হওয়ায় চলতি বছরও পাট চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন কৃষকরা।
তবে শ্রাবণ মাসের ২০ দিন হয়ে গেল পানি হচ্ছে না। খাল-বিলে একটুও পানি নেই যে সেখানে পাট জাগ (পঁচানো) দেবেন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জমিতে পাট চাষ করেছিলেন অনেকে। এখন পাট জাগ দেওয়া নিয়ে চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারছেন না তারা। মাঠের পাট নিয়ে এভাবেই দুর্ভোগের কথা জানান ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দীননাথপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, চলতি বছর পাট জাগ নিয়ে বিপদে আছি। এলাকায় আমার মতো বিপাকে পড়েছেন অনেকে। পানির অভাবে তারা সবাই পাট জাগ দিতে পারছেন না। এমন দুর্ভোগে পড়ে অনেকের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার ডোবা-নালা, খাল-বিল ও পুকুরগুলোতে একটুও পানি জমেনি। ফলে পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষকরা। এদিকে জমি থেকে পাট কেটে নেওয়ার সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর পাটের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর স্থানীয় কৃষকদের মাঝে পাট চাষে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পাটের আবাদ হয়েছে। সার, বীজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কম হওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর সোনালি আঁশের বাম্পার ফলনও হয়েছে।
পাট চাষে বাম্পার ফলন হয়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলেও এখন পাট কাটার ভরা মৌসুমে পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। চলতি মৌসুমে কৃষকরা পাট জাগ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে কেউ কেউ হাঁটুপানিতে পাট জাগ দিয়ে পচানোর চেষ্টা করছেন। এতে পাটের গুণগত মান নষ্ট হওয়াসহ পাটের দাম কম পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জমি থেকে পাট কেটে নেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও জাগ দেওয়ার পানি না থাকায় কৃষকরা ক্ষেত থেকে পাট কাটছেন না।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর পাটের দাম ভালো পাওয়ার কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩ হাজার ৭৯৭ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ বেশি হয়েছে। গত মৌসুমে পাটের আবাদ হয়েছিল ১৬ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে আর এবার আবাদ হয়েছে ২০ হাজার ৫২৭ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৭ হাজার ২৪৫ হেক্টর, দামুড়হুদা উপজেলায় ১০ হাজার ৫৩৫ হেক্টর এবং জীবননগর উপজেলায় ১ হাজার ৬৯৭ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। চলতি মৌসুমে হেক্টর প্রতি পাটের ফলন ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।
কৃষকরা জানান, এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ২-৩ দিন বৃষ্টি হলেও তা মাটি চুষে নিচ্ছে, জমিতে থাকছে না। এ কারণে পাট পচানোর মতো পানি না থাকায় কৃষকরা পাট কাটছেন না। জেলার চারটি উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ বিস্তীর্ণ পাটের ক্ষেত। আলমডাঙ্গা ও দামুড়হুদা উপজেলার কয়েকটি মাঠের চিত্র বলছে বেশ আগেই পাট কাটার সময় পেরিয়ে গেছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের তান্নু মন্ডল বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর পাট চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। এবার ১৫ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের সবুজ পাতা স্বপ্ন দেখাচ্ছিল সোনালি আঁশ ঘরে তোলার কিন্তু তা বিধি বাম। বৃষ্টির দেখা নেই কোথাও। পাট জাগ দিতে পারছি না। ফলন ভালো এবং বাজার দর ভালো থাকলেও সময়মতো পাট জাগ দিতে না পারায় চিন্তায় আছি।
তিনি বলেন, পানির অভাবে পাট জাগ দিতে না পারায় মাঠ থেকে দূরে নদীতে পাট নিয়ে যেতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। গত বছর খাল-বিলে পানি ছিল। এবারও পানি হবে সে আশায় এখনো পাট কাটা শুরু করিনি। এ বছর পাটের বাজার ভালো। বর্তমানে প্রতি মণ পাট ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আলমডাঙ্গা উপজেলার কৃষক মিরাজুল হক বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর পাটের বাম্পার ফলনও হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা অপেক্ষাকৃত উঁচু জেলা। এ জেলায় বন্যা হয় না বললেই চলে। অতিবৃষ্টি হলে পাট জাগ দেওয়ার কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এ বছর মাঠঘাটে পানি নেই। তাই পাট জাগ দেওয়ার অসুবিধা ভেবে পাট কাটতে পরছি না।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সুফি রফিকুজ্জামান বলেন, পাট চাষের জন্য চুয়াডাঙ্গার মাটি খুবই উত্তম। এ কারণে প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে পাটের আবাদ। চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৫২৭ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩ হাজার ৭৯৭ হেক্টর বেশি। এ মুহূর্তে কর্তন শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গায় পাটের বড় সমস্যা পানি। পানির অভাবে ভালোভাবে পাট পচাতে পারেন না কৃষকরা। পাট জাগের এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কৃষকরা রিবন রেটিং পদ্ধতিতে আঁশ ছাড়াতে পারেন। আমরা কৃষকদের রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছি। এতে অল্প খরচে পাট পচানো সম্ভব। এ পদ্ধতিতে পাটের মানও ভালো হয়। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।
আফজালুল হক/এনএ