মানবিক চিকিৎসকের বদলিতে মন খারাপ সবার
‘হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি, আপনার মায়ের নাম রোকেয়া খাতুন। আপনাদের বাড়ি বক্তাবলিতে। আপনার আগের ওষুধই চলবে।’ কথোপকথন শেষ করার দুই সেকেন্ডের মধ্যেই আরেকটি ফোন এল। এবার বলা শুরু করলেন, ‘মনে আছে, আপনি ও আপনার স্ত্রী পজিটিভ হয়েছিলেন। আপনাদের বাড়ি বন্দরের ঝাউতলা। কয়েক দিন একটু শারীরিক সমস্যা থাকবে। ইনশা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।’
এটা গত বছরের ঘটনা। নিজেই করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন হলো। আর প্রায় প্রত্যেক রোগীকে এভাবেই তিনি মনে রেখেছেন, এভাবেই সম্বোধন করতেন, যা রোগী ও স্বজনদের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য।
বলছি নারায়ণগঞ্জ করোনা সমন্বয় কমিটির ফোকাল পারসন ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সফরদার জাহিদের কথা। রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে যিনি ‘জাহিদ ভাই’ হিসেবেই পরিচিত।
একজন চিকিৎসক থেকে ‘জাহিদ ভাই’ হয়ে ওঠার নেপথ্যে যার প্রধান গুণটি ছিল সুন্দর ব্যবহার, মানবিকতা আর সহযোগিতার মানসিকতা। দুটি বছর ধরে যিনি সশরীরে কিংবা টেলিফোনে চিকিৎসা করেছেন কয়েক হাজার করোনা আক্রান্ত রোগীর। সেই মানবিক চিকিৎসক ডা. জাহিদ বদলি হয়েছেন, এমন সংবাদে হতাশ সবাই। চিকিৎসক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মী কিংবা সাধারণ মানুষও তার বদলির সংবাদে মনঃক্ষুণ্ন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে জেলা করোনা সমন্বয় কমিটির ফোকাল পারসন ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সফরদার জাহিদকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। তার এই বদলি নারায়ণগঞ্জের করোনা পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন খোদ চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, ডা. জাহিদ গত ২ বছরে করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছু ম্যানেজ করে চালিয়ে নেওয়ায় ছিলেন পারদর্শী। ভরসা আর আস্থার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছেন এই চিকিৎসক। গভীর রাতেও যিনি কোনো আক্রান্ত বা রোগীর সেবা নিয়ে কার্পণ্য করেন না। জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে তিনি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি আদর্শ।
তবে তথ্যানুসন্ধান বলছে অন্য কথা। ডা. জাহিদের বদলির সংবাদে খুশি হয়েছেন খোদ সিভিল সার্জন অফিসের অনেক কর্তাই। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকই তার বদলিতে উল্লাস প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
সদর উপজেলাসহ জেলার ক্লিনিক ব্যবসার অনিয়মের অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ডা. জাহিদ। পাশাপাশি খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালটিকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণার পর নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালটি হয়ে উঠেছে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসাস্থল। সেই ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের অসংখ্য অনিয়মের বিরুদ্ধে ডা. জাহিদের কঠোর ভূমিকা ছিল অনেকের জন্যই বড় বাধা।
হাসপাতালের কয়েকজন নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এই হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি বা সিজারিয়ান কোনোটাই একসময় হতো না। ডাক্তাররা রোগীদের পাঠিয়ে দিতেন নিজের পছন্দসই প্রাইভেট ক্লিনিকে এবং প্যাথলজিতে। কিন্তু ডা. জাহিদের কারণে দরিদ্র রোগীরা সেই সুবিধা পাচ্ছেন এখন। জরুরি বিভাগে সাধারণ কাটাছেঁড়ার রোগী এলেও পাঠিয়ে দেওয়া হতো ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কিন্তু তা করতে বাধ্য হচ্ছেন শুধু ডা. জাহিদের কঠোরতার কারণে।
উপজেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আগে ডাক্তাররা যেতেন না সময়মতো, এখন যেতে অনেকটাই বাধ্য হচ্ছেন। এসব কারণে তার বদলিতে খুশি অনেকেই, এমনটা জানিয়ে নার্সরা বলেন, শুনেছি তাকে বদলি করানোর চেষ্টা চলছিল আগে থেকেই।
যদিও এ ব্যাপারে সেই মানবিক ডাক্তার সফরদার জাহিদ কোনো মন্তব্য না করে জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বদলি একটি নিয়ম মাফিক বিষয়। আমাকে যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেখানেই তা পালন করব।
জেলা করোনা সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, এই মুহূর্তে তার চলে যাওয়া করোনা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক বিষয় বলে মনে করছেন অনেকেই। যেহেতু এখন মহামারি ও করোনার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই আপাতত ডা. জাহিদ নারায়ণগঞ্জেই তার দায়িত্ব পালন করবেন।
এনএ