প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে ১৯ হাজার মানুষ
২৫ জুলাই, বিশ্বে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হচ্ছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারায় পানিতে ডুবে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর মারা যায় ১৯ হাজার মানুষ।
পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধকল্পে এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘যে কেউ পানিতে ডুবে যেতে পারি, সবাই মিলে প্রতিরোধ করি’। পানিতে ডুবে মৃত্যুর বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কিশোরগঞ্জ জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমষ্টির গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের গেটওয়ে হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলায় অন্তত ৪৩ জন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার তথ্য উল্লেখ করেছে সমষ্টি।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদে এ সংখ্যা আরও বেশি। আর চলতি বছরের সাত মাসেই কিশোরগঞ্জ জেলায় পানিতে ডুবে ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এছাড়া ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৯ মাসে কুড়িগ্রাম জেলায় অন্তত ৬৩ জন, নেত্রকোনায় ৫৪ জন, চট্টগ্রামে ৪২ জন, পটুয়াখালীতে ৩৯ জন এবং দিনাজপুর ও সিরাগঞ্জে ৩৭ জন করে মানুষ পানিতে ডুবে মারা গেছে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর মধ্যে মোট ৮২ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এদের ৮০ শতাংশের বয়স ৯ বছরের কম। পরিবারের সদস্যদের অসতর্কতার কারণে সিংহ ভাগ মৃত্যু ঘটছে। পানিতে ডুবে মোট মৃতদের ৮১ শতাংশ পরিবারের সদস্যদের অগোচরে পানির সংস্পর্শে যায় এবং ডুবে মারা যায়।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ পরিচালিত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংবাদ বিশ্লেষণ থেকে এমন তথ্য উঠে এসছে।
এ বছর ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রথমবারের মতো পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ বিষয়ক একটি ঐতিহাসিক রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। এর ফলে জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। রেজুলেশনটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার ও দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। শিশু সুরক্ষার জন্য দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষে এ বিষয়ে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিপিপিটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী চলতি বছেরে কিশোরগঞ্জ জেলায় পানিতে ডুবে যে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২২ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলার নিকলী হাওরে গোসল করার সময় পানিতে ডুবে রাজিব হোসেন (২৩) নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। ২০ জুলাই মঙ্গলবার দুপুরের দিকে জেলার তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের কাজলা-খালপাড়া এলাকায় ডোবার পানিতে ডুবে ময়না (৫) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ১৮ জুলাই রোববার দুপুরের দিকে নিকলী উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের নানশ্রী-ইসলামপুর হাটি এলাকায় হাওরের পানিতে ডুবে মো. রিফাত (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ১৬ জুলাই শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের চরচাড়ালবন্দ এলাকায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ডুবে জুনায়েন (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
১৪ জুলাই বুধবার বিকেলে জেলার বাজিতপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে মিলন মিয়া (২২) ও ইবনে রোমান শিমুল (১৭) নামে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার জেলার ইটনার বাদলা ইউনিয়নের শিমলা শান্তিপুর গ্রামের ইলয়াস মিয়ার মেয়ে পাপিয়া আক্তার (৫), একই এলাকার মুন্নাছ মিয়ার মেয়ে ফারজানা আক্তার (৫), করিমগঞ্জ উপজেলার কলাতুলি পশ্চিমপাড়া গ্রামের মঙ্গল মিয়ার শিশুপুত্র জাহাঙ্গীর ও নিকলী উপজেলা সদরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পানিতে পড়ে যাওয়া এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে ডুবে মো. পারভেজ মিয়া (২৮) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
২১ জুন সোমবার দুপুরে জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুনধর ইউনিয়নের দক্ষিণ আশতকা-নূরের ভিটা গ্রামে ডোবার পানিতে ডুবে আবুল কাশেমের মেয়ে আয়শা আক্তার (১০) ও একই গ্রামের কামাল মিয়ার মেয়ে আশামণির (৯) মৃত্যু হয়। ১৮ জুন শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে জেলার কটিয়াদী উপজেলার বাগরাইট গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে মাজহারুল ইসলাম সৌরভ (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ৪ জুন শুক্রবার ইটনায় মায়ের সঙ্গে গোসলে গিয়ে নদীর পানিতে ডুবে আবু শাহেদ (৩০) নামের এক প্রতিবন্ধী যুবকের মৃত্যু হয়।
৩১ মে সোমবার বিকেলে জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া ইউনিয়নের টামনি আকন্দপাড়া গ্রামে খালের পানিতে ডুবে মালয়েশিয়া প্রবাসী কবির উদ্দিনের ছেলে আফাজ (৮) ও আবদুর রশিদের ছেলে লামিমের (৭) মৃত্যু হয়। ১৫ মে শনিবার বিকেলে জেলার মিঠামইন উপজেলার ঢাকি এলাকায় হাওরে গোসল করার সময় পানিতে ডুবে মাজহারুল ইসলাম (২৭) নামের এক পর্যটকের মৃত্যু হয়।
১ মার্চ সোমবার দুপুরে জেলার হোসেনপুর উপজেলার শাহেদল ইউনিয়নের দাপুনিয়া গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে প্রমি আক্তার (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
৯ জানুয়ারি শনিবার দুপুরে অষ্টগ্রাম উপজেলার কাস্তুল ইউনিয়নের লঞ্চঘাট এলাকার ধলেশ্বরী নদী থেকে কডু মিয়া (৪৫) নামে লঞ্চের এক বাবুর্চির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ জানুয়ারি সোমবার সন্ধ্যায় ইটনা উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদীতে পড়ে নিখোঁজ হৃদয় (১৮) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
সমাজকর্মী মায়া ভৌমিক বলেন, ছোট বেলা থেকেই শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে ও এ বিষয়ে পরিবারের বড়দের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে তাহলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া প্রশাসনেরও এ বিষয়ে আরও বেশি প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার সুমন চন্দ্র দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে জানান, মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোনো নিদর্শনা আসেনি। তবে আমার স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর তালিকা তৈরি করে থাকি এবং তাদেরকে এককালীন কিছু সহায়তাও দিয়ে থাকি।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনেছি ২৫ জুলাই আন্তর্জাতিক পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দিবস পালনের জন্য আমাদের কাছে এমন কোনো নিদের্শনা আসেনি। নিদের্শনা এলেই সেই মোতাবেক প্রচার প্রচারণা করব। আর এমনিতেই কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে অনেক পর্যটক আসে সাঁতার না জানার কারণে তারাও পানিতে ডুবে মারা যায়। তাই এ বিষয়ে প্রচার প্রাচারণা করা হয়।
এমএএস