রিফাত হত্যার ২ বছর : দ্রুত রায়ের বাস্তবায়ন চায় পরিবার
বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় বছর আজ। ২০১৯ সালের এই দিনে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বন্ড বাহিনী। পরে ওই দিন বিকেলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত।
ঘটনার দুই বছর হলেও এখনো রিফাতের স্মৃতি আঁকড়ে অঝোরে কাঁদেন তার মা-বাবা ও একমাত্র বোন। সকাল বিকেল ছেলের কবরের পাশে প্রার্থনায় মগ্ন হন মা ডেইজি আক্তার। নিহত রিফাতের স্বজনদের দাবি, আদালত খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন এ মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।
এ বিষয়ে নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ বলেন, রিফাত আমার একমাত্র ছেলে ছিল। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। মিন্নির কারণে আমার সেই সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমি পুরুষ বিধায় বিভিন্ন স্থানে যাই, ঘুরে বেড়াই। এ জন্য ছেলে হারানোর শোক কিছুটা ভুলে থাকার সুযোগ পাই। কিন্তু আমার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা বাড়িতে থাকে। তারা সবসময় রিফাতের শূন্যতাকে অনুভব করে। রিফাতের শোকে আমার স্ত্রী নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী। আমাদের ছেলে হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যকর হলে হয়তো কিছুটা সান্ত্বনা পাব। আদালত খোলার সঙ্গে সঙ্গে এ মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার অনুরোধ জানান তিনি।
রিফাতের মা ডেইজি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি আমার বাবাকে (রিফাত) ছাড়া থাকতে পারি না। আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব এ মামলার বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করে রায় বাস্তবায়ন করা হোক। এরপর তিনি আরও কিছু বলতে চাইলেও কান্নায় ভেঙে পড়ার কারণে কোনো কথা বলতে পারেননি।
মামলার বিচার কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এম এ আমিন উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে সকল মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।
রিফাত হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পেপারবুক প্রস্তুত হলেই রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুত শুনানি হয় সে বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নেব।
রিফাতকে কুপিয়ে জখমের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। দাবি ওঠে দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। এ ঘটনার পরের দিন বরগুনা সদর থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত রিফাত শরীফের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন পর এ মামলার প্রধান আসামি বন্ড বাহিনী প্রধান সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ ছাড়া এ হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর এ মামলার প্রধান স্বাক্ষী ও নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। রিফাত হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে নানা নাটকীয়তার কারণে এ ঘটনার সংবাদ স্থান পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।
পরে দীর্ঘ তদন্ত শেষে ওই বছরের ১ অক্টোবর বিকেলে প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ক্যাটাগরিতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে বরগুনার সিনিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে আসামি করা হয়।
এরপর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার কাজ শুরুর জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার শুরুর জন্য শিশু আদালতে মামলাটি প্রেরণ করেন। পরে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার কাজ শুরু করেন। আর একই বছরের ৮ জানুয়ারি বরগুনার শিশু আদালত অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিচার কাজ শুরু করেন। পরে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওই বছরের ৮ মার্চ থেকে ছয় মাসের জন্য এ মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
পরে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করেন আদালত। এ রায়ে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রায়ে মিন্নিসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আর বাকি চার আসামিকে খালাস দেন আদালত।
অন্যদিকে বিচার কাজ শেষে একই বছরের ২৭ অক্টোবর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির রায় ঘোষণা করেন বরগুনার শিশু আদালত। এতে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছয় আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে আদালত।
এ ছাড়া চারজনকে পাঁচ বছর এবং একজনকে তিনি বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়। পরে নিম্ন আদালতের এ রায়ের পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন দণ্ডিত সকল আসামি। তবে করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় থমকে আছে এ মামলার বিচার কার্যক্রম।
এ মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান এবং আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
সাইফুল ইসলাম মিরাজ/এসপি