সরকারি চাকরি না করে এমি এখন কারখানার মালিক
গ্রামীণ কুসংস্কার আর প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে নিজেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমি আক্তার। কেবল সফল স্ত্রী বা মা নন, তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম করে নিজ পরিচয়ে এমি এখন পঞ্চগড়ের অন্যতম সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ পরিচিত লাভ করেছেন।
দেশের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাসিন্দা এমি আক্তার। সরকারি চাকরি হওয়ার পরও স্বামীর ইচ্ছায় চাকরিতে যোগদান করেননি। স্বামী বদরুজ্জোহা ও একমাত্র মেয়ে স্নেহাকে নিয়ে বসবাস করেন উপজেলার ভজনপুর এলাকায়। চাকরি করতে না পারলেও এমি আক্তারের প্রবল ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করবেন। পাশাপাশি অন্য নারীদের দেখাবেন উদ্যোক্তা হওয়ার পথ।
২০১৬ সালে জমানো ৩০ হাজার টাকা দিয়ে স্নেহা ফ্যাশন অ্যান্ড বুটিক হাউস নামে শুরু করেন তার কাপড়ের শো রুম। ঢাকা থেকে নারীদের বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক নিয়ে এসে তার দুকক্ষবিশিষ্ট ভাড়া বাড়িতেই যাত্রা শুরু তার। এভাবে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এলাকায় তিনি ব্যাপক সাড়া পান। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্নেহা ফ্যাশন অ্যান্ড বুটিক হাউস।
শুধু স্থানীয়রা নন, জেলার দূরদূরান্ত থেকে নারীরা ছুটে আসেন তার বাড়িতে এবং কিনে নিয়ে যায় বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাকসহ প্রয়োজনীয় কাপড়। এমি এখন অনলাইনের মাধ্যমেও তার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনলাইনেও ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন তিনি। এখন দেশের বিভিন্ন জেলার থেকে পাচ্ছেন নতুন নতুন অর্ডার।
সফলতা অর্জনের পর এমি পঞ্চগড় জেলা শহরের নিমনগর এলাকায় বাবার বাড়িতেও গড়ে তুলেছেন স্নেহা ফ্যাশন অ্যান্ড বুটিক হাউসে কারখানা। সেই কারখানায় এখন এলাকার ২৫ থেকে ৩০ জন গরিব ও অসহায় নারীর সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। এখানে কাজ করে তারা তাদের জীবনজীবিকার পরিবর্তন আনছেন।
জানা যায়, এমি আক্তারের কুটিরশিল্পের কারখানায় নকশিকাঁথা, থ্রি-পিস, শাড়ি, ছোট-বড়দের বিভিন্ন পোশাক, চাদর, শাড়ি, গাউন, বিছানার চাদর, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন পোশাকে হাতে তৈরি বিভিন্ন নকশার কাজ করেন নারীরা৷ আর এসব পোশাকে সব ডিজাইন করেন তিনি নিজেই৷ কারখানায় এসব পোশাকে ডিজাইন ও হাতের কাজ শেষ পরবর্তীতে তিনি পঞ্চগড় থেকে ভজনপুর এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন।
স্নেহা ফ্যাশন অ্যান্ড বুটিক হাউসে কাপড় কিনতে আসা ক্রেতা আইরিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমি আপার শো রুমে নিত্যনতুন ডিজাইনের কাপড় আমরা ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারি। তার শো রুমে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে আমরা খুব সহজে ও ভালো মানের কাপড় কিনতে পারি। এতে আমাদের নারীদের জন্য অনেক সুবিধা হয়। আমরা তো সব সময় বাজারে গিয়ে কাপড় কেনার সময় পাই না। তাই এখানে নিজের ইচ্ছেমতো দেখেশুনে কাপড় নিতে পারি।
একই কথা বলেন আরেক ক্রেতা শেফালী বেগম শেলী, ছয় বছর ধরে আমি এমি আপার শো রুমে কাপড় কিনি। তিনি নারীদের কসমেটিক থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য তার শো রুমে বিক্রি করেন। এতে আমরা আমাদের পছন্দমতো সবকিছু সংগ্রহ করতে পারি।
স্নেহা ফ্যাশন অ্যান্ড বুটিক হাউসে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া নারী পিংকী বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। স্বামীর উপার্জনে কোনো রকম আমাদের সংসার চলত। বাড়ির কাজ শেষ করে আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন নারী এমি আপার কারখানায় কুটিরশিল্পের কাজ করি। এতে আমরা যা আয় করি, তা দিয়ে আমাদের সংসার ভালোই চলছে। আগে না খেয়ে দিন কাটলেও এখন ভালো যাচ্ছে আমাদের দিন।
একই কথা জানান কল্পনা আক্তার। তিনি বলেন, এমি আপার কুটিরশিল্পে হাতের কাজ করে আমার বেকার জীবনের অবসান ঘটিয়ে এখন আমি প্রতিদিন অনেক টাকা আয় করি। আর এই টাকা দিয়ে আমার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার ভালোই চলছে।
সফল উদ্যোক্তা এমি আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, আমার খুব ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু একটা করব। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে এলাকার গরিব নারীদের জন্য কিছু করব। আর আমার এই স্বপ্নপূরণে আমি ছয় বছর আগে আমার জমানো মাত্র ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নারীদের পোশাক নিয়ে শুরু করি আমার ব্যবসা।
তিনি বলেন, ধীরে ধীরে আমার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। আমি ভাড়া বাড়িতে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। আমার প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ২২ থেকে ২৪ হাজার টাকা আয় করছি এবং পাশাপাশি আমার জায়গা স্বল্পতা হলেও আমি আমার বাবার বাড়িতে একটি কুটিরশিল্প কারখানা গড়ে তুলেছি। সেখানে গরিব-অসহায় নারীরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
এমি বলেন. আমার ও আমার কারখানায় কর্মরত নারীদের পাশে যদি সরকার দাঁড়ায়, তাহলে আমি ব্যবসাটি আরও সম্প্রসারণ করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।
এমির স্বামী বদরুজ্জোহা প্রধান জাহাঙ্গীর বলেন, প্রথম দিকে আমি রাজি না হলেও পরে তার সফলতা দেখে আমি সব সময় তার পাশে থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।
তেঁতুলিয়া উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা করুণা কান্ত রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমি আক্তার তেঁতুলিয়ার গর্ব। আমি ইতোমধ্যে ওই নারীর শো রুম ও কারখানা পরিদর্শন করেছি। তিনি নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার মতো আরও ২৫ থেকে ৩০ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
তিনি বলেন, এমি আক্তারসহ তার কারখানায় নারীদের কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগ্রহী থাকলে ব্যবস্থা উদ্যোগ নেওয়া হবে পাশাপাশি তাদের সহযোগিতা করা হবে যদি তারা আগ্রহী থাকে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমি আক্তারের এমন উদ্যোগ আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। তার আরও সফলতা কামনা করছি। এ ছাড়া আমরা ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গরিব নারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি যেন ঘরে ঘরে এমি আক্তারের মতো সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলেন।
এনএ