‘আমি শুধু একটু পায়ে হাঁটার পথ চাই’

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সোনারদাইড় গ্রামে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অসহায় রহিমা খাতুন (৫৫)। স্বামীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পুরুষদের কবরস্থানের ওপর একটি কুঁড়ে ঘর করে বসবাস করে আসছেন তিনি। পলিথিন ও পাটকাঠির বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরেই কেটেছে বছরের পর বছর। তিন সন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন এখান থেকেই। মেয়ের জামাই, শাশুড়ির কষ্ট দেখে নিজ উদ্যোগে দুই রুমের একটি আধাপাকা ঘর তৈরি করে দেন ওই কবরস্থানের জমিতেই। তবে দুর্ভোগ থামেনি এখনো। ওই বাড়িতে পৌঁছানোর কোনো নির্দিষ্ট পথ না থাকায় প্রতিবেশীদের উঠান বা জমির ওপর দিয়েই যাতায়াত করতে হয় তাকে। এক সপ্তাহ আগে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে ওই বৃদ্ধার বাড়ির চারদিকে তারকাটা ও গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সম্পূর্ণভাবে ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
বৃদ্ধার থাকার সামান্য জায়গাটুকু থাকলেও যাতায়াতের পথ না থাকায় অসহায় এই নারী চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছেন। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উত্তর পাশে পেয়ারা বাগান। সেটি তারের বেঁড়া দিয়ে ঘেরা। পূর্ব পাশে বাঁশ বাগান, বাগানের মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ থাকলেও সেটাও কুল গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বাড়ির পশ্চিমে প্রতিবেশীদের উঠানের ওপর দিয়ে যাতায়াতের জায়গা থাকলেও সেটিও তারের বেঁড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণ পাশে মেহগনি বাগান দিয়েই একমাত্র যাতায়াতের পথ ছিল, সেটাও বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এক কথায় চারিপাশ কাঁটাতার, বাঁশ ও গাছের ডাল দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। জানা যায়, বৃদ্ধার আচরণের কারণে তাকে বাড়ি থেকে বের হতে না দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখে শাসন বা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, মেহগনি বাগানের মালিক কুদ্দুস মিয়া। পেয়ারা বাগানের মালিক সোনা মিয়া। বাঁশ বাগানের মালিক মুস্তান। পশ্চিম পাশে কামাল মিয়ার বাড়ি। দক্ষিণ পাশে জাহিদ ও সাদ্দামের বাড়ি। সবাই যৌথভাবে যাতায়াতের পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।
যাতায়াতের পথ অবরুদ্ধ করে রাখার পর রহিমা প্রথমে হলিধানী ইউনিয়ন পরিষদের দ্বারস্থ হন। ইউনিয়ন পরিষদ প্রথমে কুদ্দুস মিয়াকে একটি নোটিশ প্রদান করেন। পরিষদের নোটিশ পেয়েও তিনি মিটিংয়ে উপস্থিত হননি। পরিষদ থেকে আবারো তাকে নোটিশ দেওয়া হলে সেই নোটিশও অবমাননা করেন তিনি। পরবর্তীতে একটি সালিসি প্রতিবেদনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ রহিমাকে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রতিবেশী তাসলিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রহিমা বাপ-দাদাদের ভিটেই কুঁড়ে ঘর করে বসবাস করে আসছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশীদের বাড়ির ওপর দিয়ে এবং এই মেহগনি বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু কুদ্দুস তার মেহগনি বাগানটা সম্পূর্ণ কাঁটাতার ও বাঁশ দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। কেন ঘিরেছে, কি কারণে ঘিরেছে আমি বলতে পারবো না। তবে এখন রহিমার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তিনি বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না।
প্রতিবেশী কুদ্দুস মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তার ভাতিজা মুক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামে নিয়মিত হাঁস মুরগি চুরি হয়। আর এই চুরি হয়ে যাওয়া হাঁস মুরগি সব ওই বাগানের পথ দিয়ে নিয়ে যায়। যা বাগানের পাশের পেয়ারা বাগানে পাওয়া যায়। গ্রামে চুরি করে বের হবার ওই একটাই রাস্তা। গ্রামের লোকজন সবাই আমাদেরকে সন্দেহ করে। আমাদের সাথে ওই পথ নিয়ে বকাঝকা করে। এ কারণে ওই বাগানের পথ বন্ধ করে দে য়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিবেশী রহিমা গোরস্থানের ওই জমিতে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। এর আগে তাদের শরীকদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাতায়াত করতেন, সেই দিক দিয়ে পথও আছে। আমরা ওখান থেকে চলে আসার পর রহিমা আমাদের জমির ওপর দিয়ে ১০ বছর ধরে আসা-যাওয়া করে। গ্রামের এই ঝামেলার কারণে পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রহিমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি খুবই অসহায় একজন মানুষ। পূর্ব পুরুষদের কবরস্থানের ওপরেই কুঁড়ে ঘর করে বসবাস করে আসছি। ছেলে ও মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর জামাই আমার কষ্ট দেখে দুই রুমের এই বাড়িটা করে দিয়েছে। আগে কুদ্দুস মিয়ার বাগানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতাম। এখন সবাই আমার যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ি থেকে বাইরে বের হবো তার কোন উপায় নেই। চারিদিক থেকে কাঁটাতার, বাঁশ ও কাঁটা দিয়ে পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি শুধু একটু হাঁটার পথ চাই।
তিনি বলেন, আমি যখন বাড়ি করি তখন কুদ্দুসের সাথে কথা ছিল সে আমার যাতায়াতের পথ দেবে। কিন্তু এখন পথ না দিয়ে আমাকে চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
হলিধানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এনামুল হক নিলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভুক্তভোগী রহিমা ইউনিয়ন পরিষদে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা কুদ্দুসকে একটা নোটিশ করেছি। কুদ্দুস নোটিশ পেয়েও পরিষদে আসেননি। পরবর্তীতে আবারো নোটিশ করা হয়েছে রহিমাকে পথ দেওয়ার জন্য। কোনোভাবেই রহিমার পথ তিনি ঠেকাতে পারবেন না। আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করব রহিমাকে যাতায়াতের পথ বের দেবার। কুদ্দুস কিংবা তাদের প্রতিবেশীরা যদি সহজে তার পথ না দেয়, তাহলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/এমএএস