রং-বেরঙের ঘুড়িতে রঙিন রংপুরের আকাশ

বাংলা বছরের শেষ দিন আজ। চৈত্র মাসের এই শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। আবহমান বাংলার চিরায়িত বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এ দিনটি। বছরের শেষদিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন।
সেই ধারাবাহিকতায় নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবের। এ উৎসবে বিভিন্ন আকৃতি ও রঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায় আকাশ। সৃষ্টি হয় মনোরম দৃশ্যের। হাতে নাটাই নিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত থাকে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ। উৎসবে চিল, বাটারফ্লাই, সাপ, ঈগল, মাছ প্রভৃতি ধরনের ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখা যায়।
রোববার (১৩ এপ্রিল) দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত কারমাইকেল কলেজের জিএল মাঠ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফুটবল খেলা মাঠে এক ঝাঁক ঘুড়ি প্রেমীদের পদাচরণা ও প্রতিযোগিতায় রঙিন হয়ে উঠেছিল নীলাকাশ।
সকালে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় কারমাইকেল কলেজে উপস্থিত ছিলেন সাবেক উপাধ্যক্ষ ড. রেহেনা খাতুন, কারমাইকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক রকিবুস সুলতান মানিকসহ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী, পহেলা বৈশাখ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও বেরোবি প্রক্টর ড.ফেরদৌস রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী কর্মকর্তা-কর্মচারী।
নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুড়ি নিয়ে আসা নানা বয়সী মানুষ উৎসবে যোগ দেন। জিএল মাঠের আকাশ বিভিন্ন রঙের ঘুড়িতে সুশোভিত হয়। দীর্ঘদিন পর ঘুড়ি উড়াতে পেরে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করেন অংশগ্রহণকারীরা। মাদক থেকে যুব সমাজকে দূরে রাখাসহ দেশীয় ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ঘুড়ি উৎসবের মতো আয়োজন অব্যাহত রাখার দাবি জানান তারা।
অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব। মোবাইল-কম্পিউটারসহ আধুনিক সব ডিভাইসের ভিড়ে আগের মতো ঘুড়ি উৎসব আর চোখে পড়ে না। তবে পুরান ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ঐতিহ্যবাহী এই ঘুড়ি উৎসব এখনো কিছুটা বিদ্যমান। এবারই প্রথম কারমাইকেল কলেজে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা ঘিরে আনন্দের কমতি ছিল না।
কারমাইকেল কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠক কাকাশিস এর সভাপতি বাঁধন বাগচী বলেন, চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উৎসব একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। তবে এই উৎসব অনেকটাই কমে গেছে। আগের মতো চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘুড়ি উৎসবের জৌলুস আর নেই। মোবাইল-কম্পিউটারসহ আধুনিক সব ডিভাইসের ভিড়ে ঘুড়ির বেচা-বিক্রিও আর আগের মতো হয় না বলে কারিগররাও আগের মতো ঘুড়ি তৈরি করছে না। তারপরও কলেজ কর্তৃপক্ষ ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করায় আকাশপানে তাকিয়ে সবার মধ্যে বাড়তি আনন্দ উচ্ছ্বাসে দেখা যায়।
কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলা বর্ষবরণকে ঘিরে আমরা দুই দিনব্যাপী উৎসব পালন করছি। এর মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ছিল ঘুড়ি উৎসব। সোমবার বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হবে। কলেজের শিক্ষার্থীসহ আগত অংশগ্রহণকারীদের পদচারণায় আয়োজন উৎসব মুখর হয়েছে।
এদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও বিকেলের আকাশ রঙিন ছিল রং-বেরঙের ঘুড়ির উড়োউড়িতে। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে আসা বেরোবি শিক্ষার্থী জাকারিয়া বলেন, ঘুড়ি কাটাকাটি ও রং-বেরঙের জমকালো আয়োজনে জমে উঠেছে উৎসব। আমরা এ উৎসবে খুবই আনন্দ করছি। আশা করছি বৈশাখী মেলাও সুন্দর আয়োজন থাকবে।
বিজয় ২৪ হলের শিক্ষার্থী সবুজ মিয়া বলেন, আমরা হল থেকেই ঘুড়ি ওড়ানো দেখতেছিলাম। আগে গ্রামে এমন উৎসব হতো এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এমন আয়োজন দেখতে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে। আমার বারবার শুধু গ্রামের কথাই মনে পরছিল।
এদিকে আগামীকাল ১৪ এপ্রিল, সোমবার পহেলা বৈশাখে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে। সকালে ক্যাম্পাসে শুরু হবে আনন্দ শোভাযাত্রা যা পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করবে। এরপর অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর সামনে অনুষ্ঠিত হবে বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন বিভাগের স্টল প্রদর্শন। এরপর দুপুর ২টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মিডিয়া চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রত্যেক বিভাগের জন্য পৃথক স্টল থাকবে।
এদিকে সারা দেশের মতো বাংলার নতুন বছর ১৪৩২-কে স্বাগত জানানোসহ প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় বিভাগীয় নগরী রংপুর। বাঙালি আমেজে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চলছে বর্ষবরণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
পহেলা বৈশাখের চিরন্তন উৎসবকে ঘিরে নতুন প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন, শিল্পকলা একাডেমি, সাংস্কৃতিক ঐক্য পরিষদ, রামবা, রবীন্দ্র সম্মিলনসহ বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সংগঠন। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বর্ষবরণে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
সাংস্কৃতিক ঐক্য পরিষদ রংপুরের আহ্বায়ক মাহমুদুন নবী ডলার বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলা বর্ষবরণে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য লালন ও ধারণ করে আমরা এই উৎসব পালন করি। আর উৎসবের মধ্যদিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিখড়ের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। তবে এবারের আয়োজনে স্বৈারাচার না থাকায় নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে। মানুষের মাঝে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে।
আরও পড়ুন
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী বলেন, বর্ষবরণ রংপুরবাসী যাতে নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পারে এ নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি রয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরি মাঠ ও শিল্পকলা পরিদর্শন করা হবে। তা ছাড়া সাদা পোশাকে কাজ করছেন মাঠে একাধিক টিম।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বরণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকদফায় প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। জিলা স্কুল বটতলায় বর্ষবরণের সব প্রস্তুতি চলছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে