কুয়াকাটায় ২৫০০ টাকার রুম ভাড়া ৪৬৬৬ টাকা

দেশের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে পর্যটকদের চাপ, কিন্তু সেখানে পরিপূর্ণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা না থাকায় রীতিমতো হতাশ আগত পর্যটকরা। সেবার মান উন্নয়ন না হওয়ায় ঘুরতে এসে পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়া আদায়, প্রতারণা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশনসহ নানা হয়রানিতে আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে কুয়াকাটায় আগতদের। এতে পর্যটক আকর্ষণে পিছিয়ে যাচ্ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা এবং পর্যটনকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা।
ঈদুল ফিতরের টানা ৯ দিনের লম্বা ছুটিকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। এমন হতাশাজনক চিত্র বার বার গণমাধ্যমে আসলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দিনে দিনে অব্যবস্থাপনা আরও প্রকট হচ্ছে। পর্যটকদের সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না কাউকে। তবে প্রশাসন দাবি করছে, সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আর এতেই হতাশ কুয়াকাটায় আগত হাজারো পর্যটক। তাদের দাবি একটাই, একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, পরিপাটি এবং হয়রানিমুক্ত পর্যটন নগরী চাই।
কুয়াকাটায় পর্যটক বাড়লেই অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন একটি চক্র—এমন অভিযোগ করেছেন কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা অনেক পর্যটক। এক দিনের অবকাশযাপনে গত ৩ এপ্রিল কুয়াকাটায় এসেছেন ব্যবসায়ী শিহাব উদ্দিন। পরিবার, বন্ধু এবং ছোটভাইদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকার হোটেল প্যারাডাইসে ওঠেন। এক দিনের জন্য নন এসি ২টি রুম এবং এসি রুম ১টি, মোট তিনটি ডাবল বেডের রুম ভাড়া নিয়েছেন ১৪ হাজার টাকায়। তাতে প্রতিটি রুমের ভাড়া আসে ৪৬৬৬ টাকা করে। কিন্তু হোটেলের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকায় দেখা যায়, এই রুমগুলোর ভাড়া নির্ধারণ করা আছে ২৫০০ টাকা করে।
পর্যটক শিহাব উদ্দিন ও তার বন্ধুরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বর্ষা মৌসুমে আমি পরিবারসহ কুয়াকাটায় আসি, তখন একই হোটেলে ২৫০০ টাকা দিয়ে এসি রুম নিয়েছিলাম। আগের নিয়মে বাজেট করে আমরা ২ দিনের জন্য কুয়াকাটায় এসেছিলাম। কিন্তু হোটেল রুম থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজেটও কমে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে এক দিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাড়তি ভাড়া নিয়েছে এটা নিয়ে কোনো কষ্ট নেই ভালো সার্ভিস দিলেই হতো, হোটেলের রুমে নেই সাবান, সেম্পু, টিসু। নেই কোনো প্লেট, গ্লাস। বাচ্চাদের খাবার খাওয়াতেও কষ্ট হয়েছে অনেক। সব মিলিয়ে কুয়াকাটার প্রতি কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বলেও মন্তব্য করেন এ পর্যটক।
একইভাবে পাশের হোটেল সিলভার স্যান্ডস্ ইন্ বরিশাল থেকে এসেছেন নবদম্পতি শাহরিয়ার। তারা এক দিনের অবকাশ যাপনে এসে ওঠেন এ হোটেলে। তারা নন এসি রুমপ্রতি ভাড়া নিয়েছেন ৩ হাজার টাকা করে। অথচ এ রুমগুলো দুই মাস আগেও ভাড়া হতো ২ হাজার টাকায়। কুয়াকাটায় এভাবে পর্যটক বাড়লে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে।
অন্যদিকে বরিশাল থেকে কুয়াকাটায় বেড়াতে এসেছেন সোহান ও তার বন্ধুরা কিন্তু যেই ধারনা নিয়ে তারা কুয়াকাটায় এসেছেন সেই ধারনা তাদের পুরোপুরি পাল্টে গেছে কুয়াকাটা পৌঁছানোর পরে। তিনি বলেন, আমরা বরিশাল থেকে প্রায় সময় কুয়াকাটায় আসি এবং এতদিন হোটেল ভাড়া সব সময় মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল কিন্তু আজকে অধিকাংশ হোটেলগুলোই তিন থেকে চারগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছে। কুয়াকাটায় এসে আমরা বিপদে পড়ে গেছি। এর কারণ হচ্ছে ১০০০ টাকার বাজেটের রুম এখন ৩-৪ হাজার টাকা দিয়ে নিতে হচ্ছে। এরকম হলে আমরা কুয়াকাটা কীভাবে থাকবো, আর শুধু আমরাই না এরকম চলতে থাকলে কুয়াকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে পর্যটকরা।
এদিকে খুলনা থেকে আসা জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুয়াকাটা এর আগেও আমি বহুবার এসেছি আবার বন্ধুদের সঙ্গে আসলাম, কিন্তু বরাবরই একটা জিনিস এখানে আমার চোখে পড়েছে, সেটা হচ্ছে খাবারের মান ও দাম। খাবারের বান মোটামুটি ভালো থাকলেও দামটা সব সময়ই অতিরিক্ত থাকে এখানে। সমুদ্রের পাশে বেড়াতে এসে সামুদ্রিক মাছ যদি বেশি দাম দিয়ে খেতে হয়, তাহলে তো নিজ এলাকায় বসে খাওয়াই ভালো।
পর্যটনকর্মী কেএম বাচ্চু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিড়কে পুঁজি করে হোটেল ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সেবা আর খাবারের মান নিয়েও সন্তুষ্ট নন অনেক পর্যটক। খাবারের ব্যবস্থা, কিংবা বাসস্থানের ব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা আর অব্যবস্থাপনা চরমে পৌঁছেছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহায়ত্ব এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা, এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। এগুলো যতদিনে ঠিক করা না যাবে ততদিনে কুয়াকাটাকে পরিকল্পিত পর্যটন নগরী বাড়ানো যাবে না।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে কুয়াকাটার বিলাসবহুল আবাসিক হোটেল খান প্যালেসের জেনারেল ম্যানেজার ফজলুল করিম ইমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুয়াকাটায় প্রথম শ্রেণির যে হোটেলগুলো রয়েছে। সেই হোটেলগুলোই শতভাগ নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলে। বাকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির হোটেলগুলো নিয়ে সবসময়ই সন্তোষজনক গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে হোটেলের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ একজন পর্যটক সবার আগে চায় আস্থা। তাই পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ী নেতাদের এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখা উচিত বলে মনে করছি আমি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা রিজিওনের সহকারী পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের ছুটিকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটায় হাজারো পর্যটকদের ভিড় জমেছে। তবে কিছু ছোটখাটো অভিযোগ আমরা পাচ্ছি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তিনি আরও বলেন, কুয়াকাটার সব দর্শনীয় স্থানগুলোতে আলাদা আলাদা টুরিস্ট পুলিশের টিম কাজ করছে।
এসএম আলমাস/এএমকে