‘যত কষ্টই হোক স্বজনদের মুখগুলো দেখলে সব ভুলে যাই’

ঈদ উদযাপন করতে রংপুর বিভাগের আট জেলার হাজারো মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন। তাদের চোখে-মুখে প্রশান্তির ছাপ থাকলেও শরীরগুলো ক্লান্ত। ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকলেও যে যেভাবে পারছেন বাস-ট্রাক, পিকআপ ভ্যানসহ মোটরসাইকেলযোগে গ্রামে ফিরছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউবা দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ক্লান্ত শরীরে গন্তব্যে পৌঁছলেও নেই অস্বস্তি, আক্ষেপ। বরং যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার মহাসড়কে তুলনামূলক যানজট কম বলে দাবি করছেন যাত্রীরা।
শনিবার (২৯ মার্চ) বিকেলে বিভাগীয় শহর রংপুরের প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক চাপমুক্ত দেখা গেলেও অনেককেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।
যাত্রীরা বলছেন, তীব্র রোদে খোলা গাড়িতে করে ঈদযাত্রা কিছুটা কষ্টকর মনে হলেও এবার মহাসড়কে তেমন যানজট নেই, বরং এবারের ঈদযাত্রায় অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছেন বলে জানান তারা। তুলনামূলকভাবে সড়কে হয়রানি ও দুর্ঘটনাও কম।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে রংপুর বিভাগের উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসগুলোতে যাত্রী ভরপুর। বাসে তো বটেই ট্রাক ও পিকআপভ্যানে জায়গা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের জন্য। ঢাকা থেকে রংপুরমুখী প্রতিটি যানবাহনেই রয়েছে যাত্রীর ভিড়। ঘরমুখো মানুষের চাপে যানবাহনের ছোট জায়গাও যেন হয়ে উঠেছে মূল্যবান। যাত্রীদের বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ও নিম্নআয়ের মানুষ।
রংপুর নগরীর মডার্ন মোড় এলাকায় কথা হয় মারুফা আক্তার জিমি নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি গাজীপুরের মাওনা থেকে ফাইভ স্টার পরিবহনে করে সোয়া পাঁচ ঘণ্টায় রংপুরে এসে পৌঁছেছেন।
প্রতিবারের মতো এবারও গাড়িভাড়া বেশি নিয়েছে বলে অভিযোগ করে মারুফা আক্তার বলেন, প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে যাত্রাপথে ধুলোবালির কারণে একটু কষ্ট হয়েছে। তবে মহাসড়কে চন্দ্রা থেকে রংপুরে আসার পথে কোথাও খুব বড় কোনো যানজটে আটকে না থাকাটাই এবার সবচেয়ে বেশি স্বস্তিদায়ক।
মডার্ন মোড়ে বাস থেকে নেমে গন্তব্যে যেতে রিকশায় চড়েন আরেক যাত্রী জয়নাল আবেদীন জয়। এই যাত্রী গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে বাসে করে রংপুরে এসেছেন ছয় ঘণ্টায়, এ জন্য তাকে ১ হাজার ৪০০ টাকা বাসভাড়া গুনতে হয়।
জয়নাল আবেদীন বলেন, ভাড়া বেশি হেগাক, হোক না একটু ভোগান্তি তাতে কী, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারাটাই আনন্দের। পরিবার ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে আয় রোজগার করছি। বছরে দুইবার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ঈদ উদযাপন না করলে ঈদটাই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
মারুফা-জয়নালের মতো অন্যদের কাছেও ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। সেই ঈদের আনন্দ পরিবারের সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে ঈদ এলেই ছুটিতে বাড়ি যান তাদের মতো হাজারো কর্মমুখী মানুষ।
ঢাকা, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকা পিকআপভ্যান ও ট্রাকে চড়ে রংপুর বিভাগের হাজারো নারী-পুরুষ বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। শুধু ট্রাক বা পিকআপভ্যান নয় এ যাত্রায় বাহন হিসেবে রয়েছে বাস, মাইক্রোবাসসহ ছোট ছোট গণপরিবহনও।
রাতে লালমনিরহাটের উদ্দেশে ঢাকার সাভার থেকে ট্রাকে করে যাত্রা করা ফিদা মিয়া জানান, ৫শ টাকায় উঠেছি। আমার মতো অনেকেই ট্রাকে করে বাড়ি যাচ্ছেন। আমাদের কেউ গার্মেন্টস শ্রমিক কেউবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ট্রাকে যেতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু একটু টাকা বাঁচাতে পারলে বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো কিছু খাওয়া যাবে। সবার তো একরকম সামর্থ্য নেই। যত কষ্টই হোক এখন বাড়িতে পৌঁছে মা, বউ, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করবো, এটাই তো ঈদের আনন্দ।
ট্রাকচালক মতিউর রহমান জানান, ঈদে তো এই ট্রিপ আমি নিতে চাই না। সবাই ধরলো। আর নিলে তো লাভ যদিও আসা লাগবে খালি। জনপ্রতি ৫শ থেকে ৮০০ টাকা করে নিচ্ছি। মালামাল থাকলে সেটা ফ্রি নিয়ে নেই। সবাই তো পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে চায় তাদের সেই সুযোগ করে দেই।
আরও পড়ুন
এদিকে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রংপুর নগরীর মডার্ন মোড়ে দেখা যায়, বাস, ট্রাক ও পিকআপভ্যান থেকে ঘরমুখো মানুষ নামছেন। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসে মডার্ন মোড় নেমে অন্য বাসে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে যাচ্ছেন সেসব জেলার বাসিন্দারা।
ট্রাকে ঢাকা থেকে প্রায় আট ঘণ্টা যাত্রা শেষে রংপুরে পৌঁছান রাইসুল ইসলাম। সঙ্গে তার এলাকার আরও কয়েকজন পোশাকশ্রমিক রয়েছে। রাইসুল বলেন, ঝুঁকি তো থাকেই। বাসের তুলনায় ট্রাকে ভাড়া কম লাগে কিন্তু কষ্ট বেশি। বাসের যাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। যতই কষ্ট লাগুক বাড়ি ঢুকে স্বজনদের মুখগুলো দেখলে সব ভুলে যাই।
তবে বেশির ভাগ যাত্রীর অভিযোগ, বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহনে ঈদযাত্রার অযুহাতে তাদেরকে বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। তারপরও তাদের কাছে সড়কে চাপ না থাকাটাই যেন স্বস্তির ব্যাপার। মডার্ন মোড়ে বাস থেকে নেমে ঠাকুরগাঁওয়ের বাসের অপেক্ষায় থাকা মিজানুর রহমান বলেন, যাত্রাপথে ঠিক মতো যানজট পাইনি। কিন্তু তীব্র গরমে দুর্ভোগ বেড়েছে। তবে সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করাসহ দুর্ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ছিল বলেও জানান এই যাত্রী।
এদিকে ঈদে ঘরে ফেরার দীর্ঘ যাত্রাপথে অসুস্থ হওয়া যাত্রীদের সেবা দিতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। ঘরমুখো যাত্রীদের সমস্যা ও ভোগান্তি কমাতে মডার্ন মোড়ে অস্থায়ী সেবাকেন্দ্র স্থাপন করার পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সও। এই সেবা ঈদের পরবর্তী সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে জেলা র্যাব ও পুলিশ।
এ বিষয়ে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মজিদ আল বলেন, ঈদে ঘরে ফেরা মানুষেরা অনেক সময় পথে বিপদগ্রস্ত হন। তাদের সাহায্য করার মতো কেউ থাকে না। তবে এখন র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা তাদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। এ ছাড়া চিকিৎসা সহায়তার জন্য দুটি সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে।
তিনি আরও বলেন, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাতে না হয়, সে জন্য সবাইকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাচ্ছি। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে যানজট সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, ঈদ উপলক্ষে রংপুর অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ফলে এবার এই বিভাগের ঘরমুখো মানুষেরা নিরাপদ, আরামদায়ক ও স্বস্তিতে ঈদযাত্রা উপভোগ করতে পারছেন।
হাইওয়ে পুলিশ রংপুর রিজিয়নের গুরুত্বপূর্ণ জংশন পয়েন্টসমূহ গোবিন্দগঞ্জ বাজার, মায়ামনি মোড়, পলাশবাড়ী, মিঠাপুকুর, শঠিবাড়ী, পীরগঞ্জ বাজার, সৈয়দপুর এবং দিনাজপুরের ১০ মাইল এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এ সমস্ত এলাকায় টহল পার্টি দ্বিগুণ করা হয়েছে। পুলিশের সব ডিউটি কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। যাতে করে বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর-দশ মাইল বাংলাবান্ধা এই ২৫০ কিলোমিটারের মহাসড়কটি যানজট মুক্ত এবং অপরাধমুক্ত থাকে।
ইতোমধ্যে মহাসড়কে গাড়ির চাপ অনেক বেড়েছে। তবে হাইওয়ে পুলিশের ব্যাপক তৎপরতার কারণে কোথাও যানজট সৃষ্টি হয়নি। আশা করা যাচ্ছে আগামী দুই দিনে গাড়ির চাপ আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। তবে হাইওয়ে পুলিশ সেই চাপ প্রশমনে মহাসড়কের সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
হাইওয়ে পুলিশ রংপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর-দশমাইল-বাংলাবান্ধা ২৫০ কিলোমিটার মহাসড়কটি এবার যানজট ও অপরাধমুক্ত রয়েছে। রংপুর অঞ্চলের এই মহাসড়কে ৩২৫ জনেরও বেশি হাইওয়ে পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে।
রংপুর বিভাগে হাইওয়েতে যানবাহনের চাপ ইতোমধ্যেই তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে দিনরাত কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, হাইওয়ে পুলিশের এই এসপি বলেন, হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে কোথাও কোনো যানজট হয়নি। তবে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ এবং পলাশবাড়ি এলাকার বিভিন্ন স্থানে রাস্তা মেরামতের কারণে সেখানে যানবাহনগুলো কিছুটা ধীর গতিতে চলাচল করছে।
এসপি তারিকুল ইসলাম বলেন, রংপুর বিভাগে এবারের ঈদযাত্রা নিরাপদ, যানজটমুক্ত এবং আরামদায়ক হবে, ইনশাআল্লাহ।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে