‘আমাদের জীবন থেকে ঈদের আনন্দ হারিয়ে গেছে’

ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাজবাড়ীর আব্দুল গণি শেখ (৪৫)। গণির মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। গণির স্ত্রী হন স্বামী হারা ও দুই সন্তান পিতৃহারা। ২০২৪ সালে ১৯ জুলাই এরপর থেকে তাদের পরিবারের সব আনন্দ যেন ধুলোয় মিশে গেছে। আর কয়েকদিন বাদে ঈদ হলেও তাদের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ।
নিহত গণির রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানপুর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকার আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে।
গণির স্ত্রী লাকি আক্তার বলেন, ঢাকায় সিক্স সিজন হোটেলে চাকরি করতেন আমার স্বামী। বছরের দুই ঈদের এক ঈদে বাড়িতে আসতেন। গত ঈদুল আজহায় বাড়িতে আসতে পারেনি বলেছিল, ঈদুল ফিতরে বাড়িতে আসব। বাড়িতে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে ঈদের আনন্দ করব। কোরবানি ঈদে বাড়িতে আসতে না পারলেও ঢাকা থেকে মেয়ের জন্য জামা, জুতা, ছেলের জন্য শার্ট, গেঞ্জি আমার জন্য শাড়ি কিনে পাঠিয়েছিল। ফোন দিলেই বলত এবার ঈদুল ফিতরের সপ্তাহখানেক আগে বাড়ি আসব। কিন্তু গত বছরের ১৯ জুলাই আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জীবনে আর কোনদিন সেই ঈদের আনন্দ আসবে না, আর ঈদ নেই আমাদের।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, একটি পরিবারের অভিভাবক না থাকলে কেমন চলে সেটা সবাই জানে। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে আমি কষ্টে আছি। সবাই ঈদে আনন্দ করলেও আমাদের আনন্দ চোখের জলে ভাসাবে। বাবা ছাড়া সন্তানদের জীবনে প্রথম ঈদ হবে এবার। ঈদের দিন আমার ছেলে-মেয়ে জন্য সেমাই রান্না করব। ওদের শহীদ বাবার জন্য ছোট পরিসরে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করব।
গণির মেয়ে জান্নাত আক্তার বলেন, আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের বাবা আর কোনদিন ঈদে বাড়িতে আসবে না। গত ঈদে বাবা আমাদের বলেছিল, কোরবানি ঈদে আসতে পারব না। রোজার ঈদে নতুন ঘরে সবাইকে নিয়ে সেমাই খাব। আবার বাবা আর সেমাই খেতে আসবে না।
গণির ছেলে আলামিন শেখ বলেন, এই ঈদটা আমাদের এক সঙ্গে করার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বাবা আজ নেই। বাবাকে ছাড়া আমাদের পরিবারে কখনো ঈদের আনন্দ আসবে না। যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।
গণঅভ্যুত্থানে রাজবাড়ীর তিনজন ঢাকায় নিহত হয়েছেন। তাদের ঈদ উৎযাপন নিয়ে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, আমরা দুইটা পরিবারের জন্য রোজায় ইফতার সামগ্রী। একটি পরিবার ঢাকায় থাকে তাদের খোঁজ নিয়েছি। আব্দুল গণির ইচ্ছা ছিল তার নির্মাণাধীন ভবনটি ঈদের আগে কাজ শেষ করা। শহীদ গণির সেই স্বপ্ন পূরণে জেলা প্রশাসন কাজ করছে। গণির ঘর নির্মাণের কাজ চলমান। আমরা চেষ্টা করছি শহীদ পরিবারগুলোর পাশে থাকতে। তাদের স্বজন হারিয়ে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা আমরা হয়তো পূরণ করতে পারব না। তবে ঈদে তাদের যে কষ্ট হবে আমরা সেটা ভাগ করে নেব।
তিনি আরও বলেন, শহীদ গণির পরিবারসহ নিহত মোট তিন পরিবারে বৃহস্পতিবার প্রত্যেককে জেলা পরিষদের অর্থায়নে ২ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, নিহত আব্দুল গণি রাজধানীর গুলশান-২ সিক্স সিজন নামক আবাসিক হোটেলের কারিগরি বিভাগে কাজ করতেন। গত ১৯ জুলাই সকালে ঢাকার উত্তর বাড্ডার গুপীপাড়ার বাসা থেকে কর্মস্থলের দিকে হেঁটে রওনা হন। পথে শাহজাদপুর বাঁশতলা এলাকায় কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে পড়েন তিনি। সংঘর্ষ চলাকালে তার মাথার ডান পাশে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকেন গণি। পরে স্থানীয় লোকজন হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরকে