১২ দিনেও মন্টু দাসের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ

বরগুনার আলোচিত মন্টু চন্দ্র দাসের মরদেহ উদ্ধারের ১২ দিন পার হলেও এখনো তার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন- অপহরণ ও ধর্ষণ মামলায় বাদী হওয়ায় অভিযুক্ত সৃজীবের স্বজনরা তাকে হত্যা করেছেন। তবে সৃজীবের মায়ের দাবি- সৃজীবের সঙ্গে আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরীর।
বিজ্ঞাপন
দ্রুত সময়ের মধ্যেই মরদেহ উদ্ধারের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনসহ দুটি মামলারই তদন্ত সম্পন্ন করতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আব্দুল হালিম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১১ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বরগুনা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কালিবাড়ির করইতলা নামক এলাকায় নিজ বাড়ির পেছন থেকে মন্টু চন্দ্র দাসের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি বরগুনা পৌর শহরের একটি মুরগির দোকানের কর্মচারী ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মুরগির দোকানের মালিক মো. জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্টু প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর আমার দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১১ মার্চ দোকানে কাজের চাপ কম থাকায় আনুমানিক রাত ১১টার দিকে মন্টুকে দোকান থেকে ছেড়ে দেই। এরপর রাত ১টা ৪ মিনিটের দিকে মন্টুর স্ত্রী আমাকে কল দিলে জানতে পারি মন্টু বাড়ি যায়নি। পরে মন্টুর সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইলে কল দিলেও তা আর রিসিভ না করলে বিষয়টি তার স্ত্রীকে জানাই।
এ ঘটনার ছয় দিন আগে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণের পর ধর্ষণের অভিযোগে বিচার চেয়ে বরগুনা সদর থানায় বাদী হয়ে মন্টু একটি মামলা করেন। পরে ওইদিনই মামলায় অভিযুক্ত একমাত্র আসামি সৃজীব চন্দ্র রায়কে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরবর্তীতে ১১ মার্চ বিকেলে মামলার বিষয়টি সমাধান করতে সৃজীবের পরিবার ও বাদীর মধ্যে মধ্যস্থতায় আলোচনা হয় বলে জানান উভয় পরিবারের সদস্যরা।
বিজ্ঞাপন
তবে এ আলোচনা হলেও অভিযুক্ত সৃজীবের বাবা বাদীকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন জানিয়ে নিহতের বোন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাইয়ের মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার পর শুনি অজ্ঞাত একজনের সহযোগিতায় সৃজীব তাকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে যায় এবং তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পরে এ ঘটনায় থানায় গিয়ে মামলা করলে আমার ভাইয়ের সঙ্গে মীমাংসা করতে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা করেন অভিযুক্ত সৃজীবের বাবা শ্রীরাম। এছাড়া জেল থেকে ছেলে বের হলে বিভিন্ন ধরনের হামলার হুমকিও দেন শ্রীরাম। এরপর ১১ মার্চ রাত ১টার পর ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না, ভাইয়ের স্ত্রীর ফোন কলের মাধ্যমে এমন খবর পেয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির পেছনে ভাইয়ের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখতে পাই।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু নেই। এলাকার সবাই তাকে ভদ্র হিসেবে চেনে। শুধু মেয়েকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তাতেই শত্রু সৃষ্টি হয়েছে। তবে একদিকে তারা আমার ভাইয়ের সঙ্গে মিলে যেতে চাইলো আর রাতে ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার হলো, তাহলে আর ভাইয়ের শত্রু কারা?
অভিযুক্ত আসামি সৃজীবের মা কনিকা রানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ঘটনা আমরা কিছুই জানি না। আমার ছেলের সঙ্গে ওই মেয়ের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছি। তাদের বিভিন্ন সময়ে ফোনে কথা বলার রেকর্ডসহ ভিডিও এবং মেয়ের হাতে লেখা চিঠিও আছে। ছেলের কাছে শুনেছি, যেদিন মেয়েটি নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ওই দিন ওই মেয়ে আমার ছেলেকে ফোন দিয়ে দেখা করে। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে মেয়েকে বাসায় ফিরে যেতে বললে সে যায়নি। রাতে মেয়ের স্বজনরা আমাদের বাসায় এসে সৃজীবের খোঁজ করে তার মোবাইল নম্বর চায় এবং বলে তাদের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে সকালে শুনতে পাই ওই মেয়ে আমার ছেলের সঙ্গে ছিল। এরপর ওই মেয়ের স্বজনরাসহ অনেকে একত্রে এসে বাড়ি থেকে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে পুলিশে দিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পর আমরা একজনকে পাঠিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মীমাংসা করার কথা বলি এবং ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। পরে মেয়ের স্বজনরা জানায়- সৃজীব জেলে আছে থাকুক, আর মেয়েরও বয়স হোক তারপর বিয়ে দেব। এরপর তো আর তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।
অপরদিকে অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত আসামি দুজনের মধ্যে আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। পরে বিষয়টির সত্যতা অনুসন্ধানে জানা যায়- ভুক্তভোগী ওই মেয়ের হাতে লেখা চিঠিসহ ঘনিষ্ঠ কথোপকথনের ফোন কল রেকর্ড রয়েছে। এমন আরও কিছু আছে যা পুলিশ জব্দ করে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন অভিযুক্ত সৃজীবের মা কনিকা রানী।
তবে নির্যাতনের শিকার ওই কিশোরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সৃজীব দীর্ঘদিন ধরেই আমাকে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করতো। বিষয়টি আমার বাবার কাছে জানালে সৃজীবকে তিনি বকাবকি করেন। আর এ কারণেই প্রাইভেট পড়ে আসার পথে আমাকে মুখ বেঁধে সৃজীব নিয়ে যায়। পরে এ ঘটনা শুনে বিচার চেয়ে বাবা মামলা করলে ওরা তাকে শেষ করে ফেলেছে। আমার বাবার ওরা ছাড়া আর কোনো শত্রু নেই। এছাড়া আমাকেও ঘটনার দিন বেশি বাড়াবাড়ি করলে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। আমি বিচার চাই। ওর কারণে বাবাকে হারিয়েছি এবং আমার পড়ালেখাও শেষ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুটি মামলার জন্যই তদন্ত কর্মকর্তার পাশাপাশি আলাদা দুটি টিম গঠন করা হয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষের পথে। ভুক্তভোগী মেয়েটির ২২ ধারায় জবানবন্দি ও মেডিকেল রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। দ্রুতই এ মামলার প্রতিবেদন দিতে পারব। অপরদিকে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বেশ কিছু তথ্যও আমরা পেয়েছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। আশা করি খুব দ্রুতই এ মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে।
উল্লেখ্য, অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত একমাত্র আসামি সৃজীব চন্দ্র রায় বর্তমানে কারাগারে আছেন। এছাড়াও মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় সৃজীবের বাবা শ্রীরাম চন্দ্র রায়, মো. আসলাম ওরফে কালু ও মো. রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার দখিয়ে আদালতে রিমান্ড চায় পুলিশ। পরে ১৯ মার্চ প্রত্যেকের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এ ছাড়াও ভুক্তভোগী পরিবারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত ১৮ মার্চ উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর ওই বাড়িতে ২৪ ঘণ্টার জন্য পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
আব্দুল আলীম/আরএআর