ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্ট, অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন

আধুনিক সুযোগ-সুবিধা আর বিনোদনের সব ধরনের ব্যবস্থা থাকায় প্রতিদিন নানা শ্রেণির মানুষের ভিড় লেগেই থাকে ডেরা রিসোর্ট ও অ্যান্ড স্পা সেন্টারে। অবকাশযাপন করতে আসা এসব মানুষেরা খরচও করে লাখ লাখ টাকা। তবে জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদনের জন্য সব ধরনের উপকরণ থাকলেও নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের নাবায়নকৃত ছাড়পত্র। সরকারি নিয়মনীতি না মেনেই কার্যক্রম পরিচালিত করছে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরানগ্রামে পাঁচ তারকা মানের সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা থাকলেও ডেরা রিসোর্টে নির্মাণ করা হয়নি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি)। পরিবেশ অধিদপ্তর কারণ দর্শানোর নোটিশ করলেও টনক নড়েনি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের। ফলে ক্ষমতার দাপটে ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্টের কার্যক্রম।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পাকে (এশিউর ট্যুরিজম লি.) শর্তসাপেক্ষে ছাড়পত্র দেয় মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন না করেই কার্যক্রম চলমান রাখে ডেরা রিসোর্ট। ছাড়পত্রের তিন নম্বর শর্ত ভঙ্গ করায় ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ঢাকা পোস্টে ‘ডেইরি ফার্মের নামে কৃষিজমি দখল করে রিসোর্ট ও স্পা সেন্টার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমেও ডেরা রিসোর্টে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে ডেরা রিসোর্টের তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য পেতে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন সাংবাদিক জাহিদুল হক চন্দন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জেবুন নাহার স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়, ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন তদন্ত করছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশিত প্রতিবেদনের অভিযোগের ভিত্তিতে সুস্পস্ট মতামতসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হোটেল ও রেস্তোরাঁ সেলে প্রেরণের জন্য চলতি বছরের ৩ মার্চ সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক/সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক/সহকারী পরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শকসহ ছয়জনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় বালিয়াখোড়া পুরান গ্রামে অত্যাধুনিক অ্যাগ্রো ফার্ম করতে কৃষি জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সকল জমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করা হয়। পরে ২০২২ সালে ওই ডেইরি ফার্ম এলাকায় এশিউর গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার নামে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়। ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে শুরু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। সে সময় বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এলাকাবাসীদের দমাতে তাদেরকে মামলায় ফাঁসানো হয়। পরে প্রভাবশালীদের আশকারায় রিসোর্টের কাজ পুরোদমে চালু হয়। দুই বছর কাজ শেষে ২০২২ সালের ৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটির।
পরিবেশের ছাড়পত্র নবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, পরিবেশর ছাড়পত্র আমাদের ২০২৫ সাল পর্যন্ত আপডেট করা আছে।
ছাড়পত্র নবায়ণ থাকলে কেন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নোটিশ করেছে কিন্তু আমাদের তো সব কিছু আছে। আপনি এক সময় আসেন আমি বিস্তারিত আপনাকে দেখাবো।
তদন্তের বিষয়ে ওমর ফারুক বলেন, এর আগে একবার তদন্ত হয়েছিল, তবে নতুন করে তদন্তের বিষয়ে তিনি অবগত নন বলে জানান।
তবে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠোনো তার দেওয়া পরিবেশের ছাড়পত্রটি অনলাইনে স্ক্র্যান করলে দেখা যায়, ছাড়পত্রটির মেয়াদ গত ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ছাড়পত্রটিতে ২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ দেখানো হয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি উন্নয়ন কমিটির সমন্বয়কারী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে ওই এলাকার কৃষকদের ফাঁদে ফেলে কৃষিজমি নিয়েছে। কৃষিজমি ধ্বংস করে রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তবে রিসোর্টের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে না থাকায় আশপাশের কৃষিজমির ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্রের শর্তভঙ্গ করে যদি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয় এবং ছাড়পত্র নবায়ন না করে কীভাবে রিসোর্টটির কার্যক্রম চলছে সেটি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। তদন্ত কমিটি দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেবে এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করি।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট এ কে এম ছামিউল আলম কুরসি বলেন, ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারকে শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে রিসোর্ট পরিচালনা করায় তাদের ছাড়পত্র নবায়ন দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশও করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবারও নোটিশ দিয়ে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওযা হবে।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির (ডেরা রিসোর্ট) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অনিয়ম পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোহেল হোসেন/আরএআর