কুমিল্লায় মামলা করে বিপাকে ঠিকাদার

কুমিল্লায় মওদুদ আব্দুল্লাহ নামে এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সন্ত্রাসী বাহিনী। চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাকে। এ ঘটনায় মামলা করে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
ছদ্মবেশে বাসার নিচে অবস্থান নিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি। মামলা তুলে না নিলে ওই ঠিকাদারের স্ত্রীকে অ্যাসিড নিক্ষেপ, বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ ভুক্তভোগীকে মেরে মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকিসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
বুধবার (১৯ মার্চ) দুপুরে এসব তথ্য জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ঠিকাদার মওদুদ আব্দুল্লাহ। গোটা পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতার কথা জানান তিনি।
ভুক্তভোগী মওদুদ আব্দুল্লাহ কুমিল্লা নগরীর পুরাতন চৌধুরীপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াদুদ ভূইয়ার ছেলে।
জানা গেছে, মওদুদ আব্দুল্লাহ একজন ছোটখাটো ঠিকাদার। ঠিকাদারি ব্যবসার পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। ঠিকাদারি ব্যবসার কারণে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তিনি। গত বছরের আগস্টে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ভুক্তভোগীর মোবাইল নম্বরে অজ্ঞাত নম্বর থেকে কল আসে। ওই ফোনকলের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়। চাঁদা না দিলে ঠিকাদারি কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
ওই বছরের ৪ আগস্ট রাতে ভুক্তভোগী মওদুদ তার ঠিকাদারি কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। রাত ১১টার দিকে কুমিল্লার টিক্কারচর ব্রিজ এলাকায় এলে মাস্ক পরিহিত সন্ত্রাসীরা তার পথরোধ করে। এ সময় অটোরিকশা থেকে নামিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে সড়কে ফেলে যায় সন্ত্রাসী বাহিনী। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। ঘটনার পর ভুক্তভোগীর মোবাইল নম্বরে আবারও ফোন দিয়ে এবং টেক্সট মেসেজ দিয়ে মামলা না করার হুমকি দেওয়া হয়। মামলা করলে পুরো পরিবারের ক্ষতিসহ মওদুদকে গুম করে ফেলা হবে বলে জানায় সন্ত্রাসীরা।
এসব ঘটনা যখন চলছিল, ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলন দমন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কারও সহায়তা পাননি ভুক্তভোগী পরিবার। পরবর্তীতে সরকার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট ভুক্তভোগী মওদুদ বাদী হয়ে কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআইকে) নির্দেশ দেন।
মামলার পর ভুক্তভোগী একদিন মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি মাইক্রোবাসে করে ৭-৮ জন সন্ত্রাসী তার পথরোধ করে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখান এবং পুনরায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মওদুদ কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় ৮ জনের নাম উল্লেখ করে হামলা ও চাঁদাবাজির মামলা করেন।
এ মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- আদর্শ সদর উপজেলার চানপুর ডুমুরিয়া এলাকার ভুট্টো মিয়ার ছেলে যুবলীগ নেতা আরাফাত ওরফে সেলফি আরাফাত (৩৬), সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা এলাকার হাবীবের ছেলে যুবলীগ নেতা মতিন (৪৬), ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ওয়াকিলুর রহমানের ছেলে ফয়সাল (৩৮), আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী এলাকার বাবুলের ছেলে যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন এমিল (৩৮), সুবর্ণপুর এলাকার যুবলীগ নেতা মো. তারেক (৪২), আদালতপাড়া এলাকার যুবলীগ নেতা মো. মতিন ( ৩৮), ফৌজদারি এলাকার যুবলীগ নেতা আল আমিন (৩৫) এবং উকিলপাড়া এলাকার সোনিয়া (৩২)।
মামলার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন এমিলকে গ্রেপ্তার করলেও বাকিরা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামলা দুটি তুলে নেওয়ার জন্য নানা হয়রানিসহ নিয়মিত ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন আসামিরা।
ভুক্তভোগী মওদুদ আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্তরা সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক মামলা রয়েছে। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছেন। দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশ মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। বাকিরা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তিনি বলেন, সেই সন্ত্রাসী বাহিনী আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে, আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ক্লোন করেছে। ইমু আইডি হ্যাক করেছে। মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি এবং এসব বিষয় উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। সেটি আদালতে এফআইআর হিসেবে প্রসিকিউশন দাখিল করেছে। সম্প্রতি ‘স্যার বাহিনী’ নামে সন্ত্রাসীদের একটি বাহিনী আমার বাসার নিচে নিয়মিত আনাগোনা করে। তারা আমাকে এখনো মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। মামলা তুলে না নিলে আমার পুরো পরিবারের ক্ষতি করবে। আমার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া কলেজে মাস্টার্সে পড়ে। তাকে কলেজে যাওয়ার সময় অ্যাসিড মারবে বলে হুমকি দেয়। আমার স্ত্রী ভয়ে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমার বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে।
তিনি আরও বলেন, আমার বাসার নিচে ‘স্যার বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন দুর্বৃত্ত অবস্থান নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পুলিশের ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন দপ্তরের প্রধানদের বরাবর অভিযোগটি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আমি এবং আমার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আইন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমি এর প্রতিকার চাচ্ছি।
এ বিষয়ে আদালতে দায়ের করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. মোসলেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে শিগগিরই।
তবে এ বিষয়ে অভিযুক্তদের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে। বাদী অভিযুক্তদের নাম-ঠিকানায় একটু গরমিল করেছিলেন। সেজন্য আসামি শনাক্ত এবং গ্রেপ্তারে একটু সময় লাগছে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভুক্তভোগীকে আমি যে কোনো সময় ফোন দিতে বলেছি। প্রয়োজনীয় সকল ব্যাপারে সহযোগিতা করব।
আরিফ আজগর/আরএআর