পরিচয় গোপন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়ছে মানুষ
সীমান্তঘেঁষা জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধরা পড়েছে করোনার ভারতীয় ধরন। রোববার (৩০ মে) এই জেলায় ৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৪৫ জনের। এর আগে এক দিকে করোনা ধরা পড়েছে ১৬১ জনের।
গত এক দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১২ জন। এর মধ্যে সাতজনই পশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে চলছে বিশেষ লকডাউন। কিন্তু কিছুতেই ঘরবন্দি করা যাচ্ছে না এ জেলার মানুষকে। জীবিকার তাগিদে নানান কৌশলে বাড়ি ছাড়ছেন লোকজন। বিভাগীয় শহর রাজশাহী হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
যদিও পথে পথে তাদের পড়তে হচ্ছে পুলিশের বাধার মুখে। অনেকেই বলছেন, ঘটনাটি আসলেই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। আর এই কারণেই পুরো অঞ্চলে ভারতীয় ধরন সংক্রমণের শঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানাচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসছেন রাজশাহীতে। নানান কৌশলে তারা এসে উঠছেন নগরীতে। এই ক্ষেত্রে প্রধান রুট রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক।
এ ছাড়া আমনুরা-তানোর আঞ্চলিক সড়ক হয়েও লোকজন আসছে রাজশাহীতে। কিছু মানুষ ধানসুরা-নিয়ামতপুর, আড্ডা-পোরশা আঞ্চলিক সড়ক হয়েও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাওয়া এসব লোকজনের অধিকাংশই শ্রমজীবী। তাদের অধিকাংশই যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকায়। কিছু অংশ যাচ্ছে সিলেট ও চট্টগ্রামে। তারা বাড়িতে এসেছিলেন ঈদ করতে। কিন্তু লকডাউনে আটকা পড়ায় চরম বিপাকে পড়েন। আয় রোজগার না থাকায় বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছেন এসব লোকজন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রাণীহাটি কমলাকান্তপুর এলাকার বাসিন্দা তফিজুল ইসলাম। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি চট্টগ্রামে ফেরি করে স্বল্প মূল্যের মালামাল বিক্রি করেন। একই গ্রামের চারজনের একটি দলে তফিজুল ইসলাম গ্রাম ছেড়েছেন।
রাজশাহী নগরীর রেলস্টেশন এলাকায় অপেক্ষমাণ অবস্থায় পাওয়া গেল এই চারজনকে। অনেকেই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে গেলেও কথা বলেছেন তফিজুল। তার সোজা উত্তর, তার একার আয়েই চলে সংসার। ফলে বাধ্য হয়ে পথে নেমেছেন। রাত ২টার দিকে তারা চারজন একসঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। কিছুটা পথ হেঁটে, কিছু পথ নৌকায় পাড়ি দিয়েছেন। এক পর্যায়ে এসে উঠেছেন মহাসড়কে। অটোরিকশায় চেপে অলিগলি পার হয়ে সাত সকালে পৌঁছেছেন রাজশাহীতে। অন্ধকার হওয়ায় পথ চিনতে পারেননি। পথে পুলিশের তল্লাশিতে পড়তে হয়নি তাদের।
তফিজুল ইসলামের সহযাত্রী গ্রামের বাসিন্দা প্রকাশ দাস। তিনি জানান, তার এলাকা শিবগঞ্জের রাণীহাটি কমলাকান্তপুরে কারো করোনা ধরা পড়েনি। কেউ মারাও যায়নি। তার নিজেরও করোনা হয়নি। পরিবারেও কেউ আক্রান্ত নেই। এই সাহসে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছেন। অন্য তিনজনের সঙ্গে বাসে চেপে তিনিও চট্টগ্রামে যাবেন।
রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশ পথের পাশে রাখা ছিল বেশ কিছু ব্যাগপত্র। ব্যাগে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন দুই যুবক। এদের একজন মোহাম্মদ রুবেল। কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি জানান, তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। চট্টগ্রামে যাবেন। সন্ধ্যা ৬টায় বাস। তাই বসে অপেক্ষা করছেন।
কোথা থেকে এসেছেন জানতে চাইলে রুবেল দাবি করেন, তার বাড়ি স্লুইস গেট এলাকায়। কিন্তু সেটি কোন উপজেলায় জানতে চাইলে নিরুত্তর থাকেন তিনি। নিজ এলাকার নাম না জানার কারণ জানতে চাইলে ওই যুবক দাবি করেন, তিনি এলাকায় থাকেন না। তাই গ্রামের নাম ভুলে গেছেন। অবশ্য পরে জানা গেল তিনি এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। বিড়ম্বনা এড়াতে ঠিকানা গোপন করেছেন তিনি।
ঠিকানা গোপন করে এমন অনেকেই ঘোরাফেরা করছিলেন রেলওয়ে স্টেশন ও বাস টার্মিনাল এলাকায়। যারা অনেকেই নিজেদের বাড়ি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা গোদাগাড়ী বলে দাবি করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় বিষয়টি যাচাই করার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশ না করে তারা জানিয়েছেন, গোদাগাড়ীর বালিয়াঘাট্টায় পুলিশের চৌকি এগিয়ে তারা মহাসড়কে ওঠেছেন। সেখান থেকে অটোরিকশায় চেপে গোদাগাড়ী হয়ে রাজশাহী। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গায় পুলিশের চৌকি এড়িয়ে পাশের শাখা সড়ক হয়ে প্রবেশ করছেন নগরীতে। যারা পথ ভুল করছেন, তারাই গিয়ে আটকা পড়ছেন পুলিশের জালে।
তবে পথে লোকজনের প্রবাহ আটকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা আবশ্যক করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন রাজশাহী নগর পুলিশের কাশিয়াডাঙ্গা জোনের উপপুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
রোববার দুপুরের দিকে নগরীর প্রবেশ পথ কাশিয়াডাঙ্গায় পুলিশের তল্লাশি কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন নগর পুলিশের এই কর্তা। সেখানে কথা হয় পুলিশের তল্লাশি চৌকি নিয়ে। তিনি বলেন, পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে নগরীতের সবকটি পথে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। যারা রাজশাহী অভিমুখে আসছেন, তাদের পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। যারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসছেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, চেকপোস্টে অনেকেই নিজেদের গোদাগাড়ীর বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে যারা রাস্তায় নামছেন তাদের সঙ্গে পরিচয়পত্র রাখা আবশ্যক করা উচিৎ। ট্রেনের মতো বাসের টিকেট সংগ্রাহকের ক্ষেত্রে এটি বাধ্যতামূলক করা জরুরি। তাহলে তারা কোথা থেকে আসছেন সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন নগর পুলিশের সার্জেন্ট সন্দীপ মল্লিক। তিনি জানিয়েছেন, মহাসড়ক দিয়ে নানান যানবাহনে লোকজন রাজশাহীতে ঢুকছে।
লকডাউন উপেক্ষা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে লোকজন যেন রাজশাহীতে আসতে না পারে সেজন্য সর্তক রয়েছে পুলিশ। হ্যান্ড মাইকে মাইকিং করা হচ্ছে। তারপরও যারা লুকিয়ে আসছেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের করোনা পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী। তিনি বলেন, জেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭২৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০০ এর মতো শনাক্ত হয়েছে গত ঈদের পর থেকে। ঈদের আগে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ। গত ২৬ মে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশে। তারপর ৬২ শতাংশে উঠেছিল। তবে পরে একটু কমেছে। লকডাউনের সুফল পেতে আরও একটু সময় লাগবে।
তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বিভাগে করোনার কমিউনিটি সংক্রমণের শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, সীমান্তের এই জেলায় করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে যে কজনের তারা ভারত ভ্রমণ করেনটি। এটি কমিউনিটি সংক্রমণ। যেহেতেু এই এলাকার লোকজন চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে আসছেন, জীবিকার তাগিদে রাজশাহী হয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন এদের মাধ্যমে কমিউনিটি সংক্রমণের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে লকডাউন মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দেন।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এসপি