ধৈর্য আর দক্ষতায় কুলসুম যেন এক অনুপ্রেরণার নাম

ঝিনাইদহের পল্লীতে ছোট্ট একটি কারখানায় কাঠের নকশা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন কুলসুম বেগম। তার পরিশ্রমী হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ কাঠ রূপ নেয় নান্দনিক কারুকার্যে। সংসারের প্রয়োজনে কঠিন এই পেশা বেছে নিলেও ধৈর্য আর দক্ষতায় তিনি হয়ে উঠেছেন এলাকার এক অনুপ্রেরণার নাম।
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলা থেকেই কুলসুমের জীবন সংগ্রামের। স্বামীর আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়লে তিনি নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। বিবাহের আগে বড় ভাইয়ের থেকে কাঠের ওপর নকশা তৈরির কাজ শেখেন। স্বামীর অসহায়ত্বের সময়ে সংসারের হাল ধরতে বেছে নেন কাঠের ওপর নকশা খোদাই করার কাজ। পুরুষদের দখলে থাকা কাঠের কাজের জগতে প্রবেশ করা সহজ ছিল না। শুরুতে বাধা এসেছিল পরিবার ও সমাজ থেকে, কিন্তু দমে যাননি তিনি। ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে এখন তিনি দক্ষ কারিগরদের একজন।
জানা যায়, কুলসুমের স্বামী আতিয়ার রহমান ঢাকায় মাইক্রো গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন। শারীরিক অক্ষমতার কারণে কোনো কাজ করতে পারেন না। বর্তমানে তিনি বাড়িতেই থাকেন। কুলসুম দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই কাজ করেন। বড় ভাই আব্দুল খালেকের কাছ থেকে মিস্ত্রীর কাজ শিখেছেন। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। বড় মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিবাহ দিয়েছেন। ছোট মেয়েকে এইচএসসি পাস করার পর বিবাহ দেন। বড় ছেলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আর ছোট ছেলে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের সংসারে একমাত্র কুলসুমই ভরসা।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে হলিধানী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কুলসুম মেশিনের সাহায্যে কঠের ওপর দৃষ্টিনন্দন নকশা তৈরি করছেন। কখনো চেয়ারের পায়া, খাটের পায়া, আলনাসহ কাঠের ওপর বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলেছেন। তার হাতে তৈরি কাঠের খুঁদে নকশা, আর বাহারি কারুকার্য আজ বাজারে বেশ চাহিদা সম্পন্ন। নিজের হাতেই লেদ মেশিন চালিয়ে কাঠের প্রতিটি টুকরোয় ফুটিয়ে তোলেন অপূর্ব শৈল্পিকতা। তবে কাজের পরিবেশ এখনো বেশ কঠিন। সারাদিন কাঠের গুঁড়োর মধ্যে বসে কাজ করতে হয়, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি। তবুও থেমে যাননি কুলসুম।
বিজ্ঞাপন
বাজারের মুদি ব্যবসায়ী দাইত হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, কুলসুম নারী হলেও কঠোর পরিশ্রমী। তার হাতে তৈরি কাঠের নকশা এখন বাজারে বেশ জনপ্রিয়। অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তার কাছে আসে কাঠের নকশা তৈরি করতে। নারীরাও পুরুষদের মতো সমানভাবে কাজ করতে পারে—তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
হলিধানী বাজারের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুলসুম বেগম শুধু একজন কাঠশিল্পী নন, তিনি এক অনুপ্রেরণা। তার কঠোর পরিশ্রমই প্রমাণ করে, ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে সমাজের সব বাধাই জয় করা সম্ভব। জীবন তার কাছে কেবল টিকে থাকার লড়াই নয়, এটি তার নিজের স্বপ্ন গড়ার লড়াই।
আরও পড়ুন
কুলসুম বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় ভাই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন। কাঠের ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি করতেন। ছোট থেকে সেগুলো দেখে আগ্রহী হই। একপর্যায়ে ভাইকে বলি, এই কাজ শিখিয়ে দিতে। বিবাহের আগে আগ্রহ নিয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে কাজ শিখেছি। তারপর থেকে ভাইয়ের কাজে সহযোগিতা করতাম। এরপর বিবাহ হয়। আমাকে বিবাহ করার কারণে স্বামীর পরিবার মেনে নেয়নি। তারপর শুরু হয় দুশ্চিন্তা। তখন আমার স্বামী ঢাকাতে মাইক্রো গাড়ি চালাতে যান। এদিকে আমি ঝিনাইদহে কাঠের নকশা তৈরির কাজ শুরু করি। এভাবে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই কাজ করে আসছি।
তিনি বলেন, অভাবের সংসারে নারী হয়ে সংসারের হাল ধরাটা যেমন সহজ ছিল না, তেমনিভাবে নারী হয়ে কাঠের ওপর নকশা তৈরি করার কাজটাও ছিল বেশ কঠিন। আগে কেউ এই কাজকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এখন সবাই উৎসাহ দেয়।
তিনি আরও বলেন, কাঠের ওপর নকশা তৈরি করা কাজের মধ্য দিয়ে, বড় মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। ছোট মেয়েকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছি এবং তাদেরকে বিবাহ দিয়েছি। বড় ছেলেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছি, লেখাপড়া করতে না চাওয়ায় ওকে এখন বিবাহ দিয়েছি। ছোট ছেলে ১০ম শ্রেণিতে পড়েছে। আর এসব কিছুই করেছি আমার দুই হাত দিয়ে, কাঠের ওপর নকশা তৈরি করে।
কুলসুম বেগম বলেন, নারীরা এই কাজে আসুক এবং স্বাবলম্বী হোক। আমার স্বপ্ন একটি নিজস্ব কারখানা গড়ে তোলার, যেখানে নারীরা আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। যদি কোনো নারী এই কাজ শিখতে চায়, তাহলে বিনামূল্যে তাদেরকে এই কাজ শিখিয়ে দিতে পারবো। এমনকি আমার কারখানায় কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে। আমি চাই কোনো নারী অভাবের সংসারে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে আমার মতো পরিশ্রম করে মাথা উঁচু করে সমাজে বেঁচে থাকুক।
হলিধানী বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারের এক পাশে কুলসুম বেগম নামে ওই নারী দীর্ঘ ৮-৯ বছর ধরে কাঠের ওপর নকশা তৈরি করছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন আসে, তার থেকে কাঠের নকশা তৈরি করে নিয়ে যায়। একজন নারী হয়ে পুরুষের থেকেও সুন্দরভাবে কাঠের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলেন যা তার প্রশংসা করতে হয়। সরকারের কাছে আহ্বান, এমন সংগ্রামী নারীদের যদি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় তাহলে তারা আরও ভালোভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে বলে মনে করি। এ ছাড়া আমরাও বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।
হলিধানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এনামুল হক নিলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, হলিধানী বাজারের এক পাশে সংগ্রামী ওই নারী কাঠের ওপর নকশা তৈরি করেন, এমনটি শুনেছি। একজন নারী হয়ে পুরুষদের মতো কাজ করছে, এটা তার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবে আমাদের পরিষদের পক্ষ থেকে যদি কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা আসে তাকে দেওয়ার চেষ্টা করবো। তবে সরকারের উচিত এমন সংগ্রামী নারীদের পাশে দাঁড়ানো।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/এএমকে