বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যেসব কারণে পিছিয়ে বরিশাল

বরিশাল জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস থেকে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে বের হয়েছেন বাদল হাওলাদার। বিদেশ যাচ্ছেন- খুব আগ্রহ নিয়ে বিষয়টি জানালেও কী ভিসায় যাচ্ছেন জানতে চাইলেই নিষ্প্রভ তিনি। মা-বাবা, দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার তাকেই দেখাশুনা করতে হয়। দেশে ছোটখাটো ব্যবসা দাড় করানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। শেষে সৌদি আরবে পাড়ি জমানোর চেষ্টা।
বাদল বলেন, শ্বশুর বাড়ির দূর সর্ম্পকের আত্মীয়ের মাধ্যমে ভিসা ম্যানেজ করেছি। তিন থেকে সাড়ে তিন লাখের মতো খরচ যাচ্ছে। আমি মেট্রিক পাস হলেও সেদেশের ভাষা, কাজের ধরণ সর্ম্পকে কিছুই ধারণা নেই। দেশে কর্মস্থান তৈরি করে দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা না করতে পেরে শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি না সেখানে আদৌ কি ঘুরে দাড়াতে পারবো, নাকি সবই হারাবো।
বাদল হাওলাদার ১৫০০ রিয়াল মাসিক পারিশ্রমিকের চুক্তিতে শ্রমিক ভিসায় যাচ্ছেন। টাকার মূল্যে যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। শুধু বাদল হাওলাদারই নয়, বরিশাল বিভাগ থেকে প্রতিদিন ১৯০ জন কাজের সন্ধানে দেশ ছাড়ছেন, যার প্রায় সকলেই শ্রমিক।
বিদেশগামীর পরিসংখ্যান
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিভাগের ছয়টি জেলা থেকে ৫ হাজার ৭০০ জন বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ৫ হাজার ২১৯ জন পুরুষ ও ৪৮১ জন নারী জনশক্তি। সবচেয়ে বেশি বিদেশগামী বরিশাল জেলা থেকে আর সবচেয়ে কম গেছেন ঝালকাঠি জেলা থেকে।
গত চার বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি বিভাগ থেকে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮০২ জন বৈধ পথে বিদেশ গেছেন। যার মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬৪ জন ও নারী ২১ হাজার ২৩৮ জন।
বরিশাল জেলা থেকে বিদেশে গেছেন মোট ৫৭ হাজার ৬৯৪ জন, ভোলা থেকে ৩৬ হাজার ৬৬৩ জন, পিরোজপুর থেকে ২৫ হাজার ৪১৯ জন, ঝালকাঠি থেকে ১৫ হাজার ৭৫০ জন, পটুয়াখালী থেকে ১৯ হাজার ৫৫৫ জন এবং বরগুনা থেকে ২৪ হাজার ৭২১ জন। এদের মধ্যে প্রবাসে মারা যাওয়া ৫১ জনকে সরকারি খরচে দেশে আনা হয়েছে।
শুধু শ্রমিক ভিসা মিলছে যে কারণে
সরকারি হিসেব বলছে, বরিশাল বিভাগ থেকে বিদেশে পারি জমানো সকলেই নিম্ন বেতনভুক্ত শ্রমিক। এতে করে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করতে হয়। এমনকি এই অঞ্চলের মানুষ দেশের অন্য অঞ্চলের প্রবাসীদের চেয়ে কম রোজগার করতে পারে। এর দুটি কারণ শনাক্ত করেছে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের কর্মকর্তারা। প্রথমত বরিশাল বিভাগ থেকে যারা যাচ্ছেন তাদের ন্যূনতম বিদেশি ভাষা জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়ত কাজের ধারণাও নেই।
পিরোজপুর জেলা সদরের বাসিন্দা আবু জাফর ফকির জেদ্দা শহরে আছেন চার বছর ধরে। তিনি বলেন, কোম্পানি মারফত আসলেও প্রথম দুই বছর খুবই কষ্ট হয়েছে। মারধরের শিকারও হয়েছি। তখন সৌদি আরবের ভাষা বুঝতাম না তাই কাজও পারতাম না। আমি এসেছিলাম শোরুমের সেলসম্যানের ভিসায়। ভাষা না বুঝতে পারায় উটের খামারে পাঠানো হয়।
আবু জাফর ফকির বলেন, ধীরে ধীরে ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। ভাষার দক্ষতা অর্জন করার পর সেলসম্যান পদে ফিরেছি। আমি মনে করি যেদেশে আসবেন সেদেশের ভাষা আর কী কাজে আসতে চান সেটি নিশ্চিত হয়ে আসা উচিত।
আরও পড়ুন
বিদেশগামীদের গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে বরিশাল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১২টি কোর্সের মধ্য থেকে তিনটি কোর্স বেশি শিখছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। প্রথমত হাউজ কিপিং, দ্বিতীয়ত প্রাক বহির্গমন কোর্স এবং নারী-পুরুষ সম্মিলিত ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স।
মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ আহমেদ আল ইমরান বলেন, প্রবাসী পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৮ জন ভাষা ও কাজ সর্ম্পকে সাম্যক জ্ঞান রাখেন। আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যেসব নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন তারা প্রায় সকলেই তাদের কাজ সর্ম্পকে জানেন। অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী ভিসা পাওয়ার পর তিন মাসের কোর্স করতে আসেন। এছাড়া হাউজ কিপিং কোর্স যারা করেন তারা ভাষা না জানলেও গৃহকর্মীর কাজ শিখে যাচ্ছেন।
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বরিশালের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. গোলাম কবির বলেন, বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছায় টিটিসিতে যারা ভর্তি হন তারা সকলেই কম শিক্ষিত এবং দেখা গেছে শ্রমিক হিসেবেই দেশের বাইরে যান। দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিক হয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে শিল্প কারখানা বা বড় কাজের ক্ষেত্র তৈরি না হওয়ায় বিদেশে পারি দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনতে হলে দক্ষতা নিয়ে বিদেশে যাওয়া উচিত।
যা বলছে কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস
কর্মকর্তা পদে বরিশাল থেকে কারও বিদেশে যাওয়ার তথ্য জানা নেই জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের। প্রতি মাসে যারা বিদেশে যারি জমাচ্ছেন তাদের সকলেই প্রায় শ্রমিক।
কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস বরিশালের সহকারী পরিচালক একেএম সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, জনশক্তি রপ্তানিতে দেশের মধ্যে ২২তম জেলা বরিশাল। প্রথম স্থানে আছে কুমিল্লা। শুধু বরিশালই নয়, সারা দেশের চিত্রই প্রায় এক। যারা যাচ্ছেন তাদের সকলেই শ্রমিক।
বরিশাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুবই কম পারিশ্রমিকে বিদেশে যাচ্ছেন এই অঞ্চলের মানুষ। অধিকাংশ আরব দেশে যাচ্ছেন এবং তাদের কর্মচুক্তি ১১০০-১২০০ রিয়াল। অথচ প্রতিবেশী অনেক দেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি করে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা নিচ্ছেন। আমরা তা পারছি না। আমাদের জনশক্তি বিদেশি ভাষা সর্ম্পকে ধারণা রাখে না আর কর্মদক্ষ নয়। এসব কারণে আমরা বহুগুণে পিছিয়ে আছি।
আরএআর