একদিনে এতবার ভূমিকম্প হতে কখনো দেখিনি
সিলেটে সকাল থেকে পর পর পাঁচবার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (২৯ মে) দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে পঞ্চমবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগে সকাল ১০টা ৩৭ মিনিটে প্রথমবার, ১০টা ৫১ মিনিটে দ্বিতীয়, ১১টা ২৯ মিনিটে তৃতীয় এবং ১১টা ৪০ মিনিটে চতুর্থবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সিলেটে পাঁচবার ভূমিকম্প অনুভূত হলেও তিনবারের ভূমিকম্প ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ দুপুর ১টা ৫৮মিনিটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ । এর আগে ১০টা ৫১ মিনিটে দ্বিতীয় ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ছিল। ১০টা ৩৬ মিনিটে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটা রিখটার স্কেলে ছিল ৩ ও ১১টা ৩০ এ যেটা হয়েছিল সেটা ২ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল।
এই ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল সিলেটেই। পাঁচবার ভূমিকম্প হলেও সিলেটের কোথাও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। প্রত্যেকবার ভূমিকম্পের সময় সকলেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। অনেকেই রাস্তাঘাটে এসে জড়ো হন।
সিলেট নগরের জিন্দাবাজারের বাসিন্দা জোবায়ের আহমদ বলেন, বয়স হওয়ার পর থেকে একদিনে এতবার ভূমিকম্প হতে কখনো দেখিনি। জানি না এটি বড় ধরনের কোনো ইঙ্গিত কিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া মানে এটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইঙ্গিত। ভূ-গর্ভের প্লেটে কোনো কিছু ঘটছে। নয়তো এতবার ভূমিকম্প হতো না। সিলেটে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া মানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের আসাম, নেপাল ও মিয়ানমার এই চার দেশে বড় ধরণের ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটতে পারে।
এদিকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে সিলেট অঞ্চল। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই দশকেই সিলেট অঞ্চলে প্রবলমাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ভৌগলিক অবস্থান ও অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে তারা এমনটা আশঙ্কা করছেন।
ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী- ‘সিলেট অঞ্চল’ ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয় ভূ-কম্পন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
এ পর্যন্ত সংঘটিত ১৮৩৩, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯০৫, ১৯৩০, ১৯৩৪, ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালের বড় ধরনের আটটি ভূমিকম্পনের মধ্যে দুটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল (এপি সেন্টার) সিলেটের জৈন্তা পাহাড়ে। একই উৎপত্তিস্থল থেকে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ফলে সমগ্র সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিকম্পের ইতিহাসে এটি ‘দি গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিত। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহতম ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল সিলেট জেলার পূর্ব সীমান্তবর্তী ভারতে। ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৬।
ভূমিকম্পটির বিস্তৃতি ছিল উৎসস্থল থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে। এই ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ সিলেট ও আসাম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫০ সালে আসামে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণে সিলেট অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই ভূমিকম্পটি ‘তিব্বত’ নামে ইতিহাসে পরিচিত রয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ এর উপরে।
শনিবার (২৯ মে) সিলেটে ঘটে যাওয়া পাঁচটি ভূমিকম্পের মধ্যে পরিমাপক যন্ত্রে ধরা পড়া তিনটি ভূমিকম্পের ব্যাসার্ধ ছিল ১৩ কিলোমিটার। ভূমিকম্পের ব্যাসার্ধ কম থাকার কারণে সিলেটের অনেক স্থানেও এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়নি বলে জানিয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস। সিলেট আবহাওয়া অফিসও সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী পর পর তিনবার সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে বড় যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। সর্বশেষ শনিবার দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটার রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৪। এটির ব্যাসার্ধও কম থাকার কারণে আমাদের কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের সাব স্টেশনে ভূমিকম্প ধরা পড়েনি। ভূমিকম্পের সকল তথ্য পেতে হলে সর্বনিম্ন তিনটা সাব স্টেশনের তথ্য প্রয়োজন হয়। সিলেটে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। সকলের উচিত বিল্ডিং কোড মেনে দালানকোঠা নির্মাণ করা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে যারা বসবাস করেন তাদেরকে এখন থেকেই সাবধান থাকতে হবে। ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া মানে এটি আসাম, নেপাল বা মিয়ানমারে বড় ধরণের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত। এমনকি সিলেটেও এই বড় ভূমিকম্পটি হতে পারে। এখন ভূ-গর্ভের প্লেটগুলোতে কি চলছে সেটি বুঝা যাচ্ছে না। তবে কোনো একটা ঘটনা ঘটছে সেখানে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আরও তিন-চারদিন অপেক্ষা করি। তিন-চারদিনের মধ্যে সব ঠিক ঠাক থাকলে বড় ধরনের শঙ্কা কেটে যাবে। কারণ এখন পর্যন্ত যেসব ভূমিকম্প হয়েছে সেগুলোর মাত্রা খুব বেশি বড় না। তারপরেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া বাসাবাড়িতে বড় বড় আলমারির কাছে যাতে কেউ না থাকেন সেই বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।
তুহিন আহমদ/আরএআর