দুর্গম পাহাড়ের চুয়ানবিলে শিক্ষার আলো

সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নৈসর্গিক লীলাভূমি পার্বত্য জেলা বান্দরবান। দুর্গম উঁচু-নিচু পাহাড়ের অতি দুর্গম এলাকা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের চুয়ানবিল পাড়ায় বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের শিশুদের মাঝে এখন ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার আলো, যা এতদিন কল্পনাও করেনি স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের জনসাধারণ।
বিজ্ঞাপন
দুর্গম এই এলাকাটিতে ২৫টি পরিবারে ১৪০ জন সদস্য বসবাস করছে, যাদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ জন শিশু। পাড়ায় কোনো প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় শিশুরা শিক্ষা গ্রহণের মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছিল। পরবর্তীতে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বান্দরবান সেনা জোনের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি স্থাপন কাজ সম্পন্ন হয় ‘চুয়ানবিল পাড়া প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক ১ম ও ২য় শ্রেণিতে শিক্ষা গ্রহণ করছে ১৫ জন ছেলে-মেয়ে।
চুয়ানবিল পাড়াটির কারবারি মুন সাং বম কারবারি ঢাকা পোস্টকে জানান, দেশ স্বাধীনের আগে পূর্ব পাকিস্তান আমলে সরকারিভাবে এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ১৯৮০ সালে অভ্যন্তরীণ স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের গ্রুপিংয়ের কারণে স্কুলসহ মানুষজন পার্শ্ববর্তী কচ্ছপতলীতে চলে যায়। পরবর্তীতে মানুষজন এলাকায় ফিরে এলেও স্কুলটি থেকে যায় কচ্ছপতলী এলাকায়।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আমাদের এলাকার ছোট ছেলে-মেয়েরা অ-আ লিখতে পারে না। সেনাবাহিনী এখানে স্কুল করে দিয়েছে। এতে আমরা আজ অনেক খুশি।
বিজ্ঞাপন
যেখানে দারিদ্র্যতার মাঝে দুর্গম এলাকায় নিজেদের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হয় সেখানে নিজেদের শিশুদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে কচ্ছপতলী এলাকা অথবা রোয়াংছড়ি সদরে যাতায়াত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলশ্রুতিতে পাড়ার শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। আর পাড়াটি খরস্রোতা তারাছা খালের তীরবর্তী হওয়ায় বর্ষাকালে এই জায়গা দিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না, যার ফলে এই পাড়াটি বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত হয়।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিনে স্থাপিত বিদ্যালয়ের প্রথম কার্যক্রম পরিদর্শন ও উদ্বোধন উপলক্ষ্যে বান্দরবান সেনা জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএসএম মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে প্রথমে জেলা সদর হতে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলী ও পরে সাধু হেডম্যান পাড়া হয়ে দুর্গম উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে দুই ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাই দুর্গম চুয়ানবিল পাড়ায়। স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের জনসাধারণের উষ্ণ অভ্যর্থনা শেষ না হতেই কানে ভেসে আসে চুয়ানবিল পাড়া প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিশিক্ষক লাল য়ইথাং বমের স্কুলের ঘণ্টা বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আহ্বানের শব্দ। পাড়ার শিশুরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে কোমল কণ্ঠে গাইছে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-এতে অংশগ্রহণ করেন সেনা জোন কমান্ডারসহ অন্যান্য সেনা সদস্য ও উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রথমবারের মতো এই এলাকার শিশুরা নিজের দেশের জাতীয় সংগীত গাইছে দেশের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা সামনে রেখে।
বিদ্যালয়ের শ্রেণিশিক্ষিকা ডায়না বম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানের শিশুরা রোয়াংছড়ি সদর বা শহরে গিয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দীর্ঘদিন পর এখানে আমাদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দেওয়ার জন্য।
মিরাম ময় বম নামে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অনেক দূরে গিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছি, কিন্তু যাতায়াতের দূরত্বের কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারিনি। সেনাবাহিনী এই এলাকায় স্কুল দিয়েছে, আমার ছেলে-মেয়েরা এখন স্কুলে যেতে পারছে। এজন্য অনেক ভালো লাগছে।
দীর্ঘদিন পর স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় খুশি ২য় শ্রেণির ছাত্রী ভানচাতপার বম।
দুর্গম এই এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়ে বান্দরবান সেনা জোন কমান্ডার এএসএম মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুবই দুর্গম একটি জায়গা হওয়ার কারণে এখানের ছেলে-মেয়েরা মৌলিক চাহিদা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। গত বছরের নভেম্বর মাসে অভিযানিক কাজে এ এলাকায় এলে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। পরবর্তীতে পাড়াবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বান্দরবান সেনা জোনের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ‘চুয়ানবিল পাড়া প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়’ গত ৬ জানুয়ারি হতে কার্যক্রম চালু করে।
তিনি আরও বলেন, আমি আনন্দিত যে বাংলাদেশের পতাকা এখানে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এবং কোমলমতি শিশুরা প্রতিদিন এখানে জাতীয় সংগীত গায়। এটি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে আমাকে সন্তুষ্টি দেয়।
কমান্ডার এএসএম মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুল পরিচালনার সুবিধার্থে পাড়া থেকে সেনা জোনের অর্থায়নে একজন পুরুষ ও একজন নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। শিক্ষার্থীদের বই ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিমাসের পারিশ্রমিক সম্প্রীতির উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে পরিচালনা করা হবে।
দীর্ঘদিন পর দুর্গম এই এলাকায় স্কুল হওয়ায় সেনাবাহিনীর প্রতি সন্তুষ্টি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শ্রেণিকক্ষে চলছে পাঠদান, উচ্চস্বরে শিশুরা শিক্ষকের সঙ্গে পড়ছে বাংলা আর ইংরেজি বর্ণমালা। আর খানিকটা দূরে বসে নিজেদের সন্তানদের পাঠদানের দৃশ্য অবলোকন করছেন তাদের অভিভাবকরা। আগামীতেও জেলার দুর্গম অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে এরূপ প্রতিটি ভালো উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে বলে জানান জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মাহমুদুল হাসান।
এমজেইউ