রাজ্জাকের জীবন বদল থেকে সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আমার পথচলা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের পহেলা মার্চ। অফিসিয়ালি নিয়োগ পাই ২২ জুলাই প্রায় দুই বছরের এই সাংবাদিকতা জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়েছে সাফল্যের পাশাপাশি অনেক বেদনাময় মুহূর্তও। কখনো অসহায় মানুষের গল্প তুলে ধরে কিছুটা হলেও বদলে দিতে পেরেছি তাদের জীবন, কখনো বা ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ড কিংবা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী হয়ে।
একটি প্রতিবেদনে বদলে গেল রাজ্জাকের জীবন
২০২৩ সালের ২ এপ্রিল ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত হয়েছিল ‘৭ বছর ধরে বিছানায় বন্দী রাজ্জাক, জীবন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। একসময় কর্মক্ষম মানুষ ছিলেন রাজ্জাক, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতায় দীর্ঘ সাত বছর ধরে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছিলেন।
সংবাদটি ইরামন ফাউন্ডেশন নামে একটি সামাজিক সংগঠনের নজরে এলে তারা রাজ্জাকের পাশে দাঁড়ায়। একসময় যে মানুষটি চরম অসহায় ছিলেন, তার জীবনে পরিবর্তন আসে সহযোগিতার হাত ধরে। সাংবাদিকতা যে শুধু খবর পরিবেশন নয়, বরং মানুষের জীবন বদলের হাতিয়ার— এই ঘটনাই তার প্রমাণ।
সুন্দরবনের ভয়াল আগুন, সরেজমিনে বিপর্যয়ের চিত্র
২০২৪ সালের ৪ মে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। চার দিন ধরে আগুনের ভয়াবহতা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছি, স্থানীয়দের দুর্দশার কথা শুনেছি, পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছি প্রতিবেদনে।
এ সময়গুলোতে দেখেছি—কীভাবে নিঃশব্দে জ্বলছিল সুন্দরবন, কীভাবে পুড়েছে বন্যপ্রাণী, কীভাবে ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। তখন বুঝতে পেরেছি, সাংবাদিকতার কাজ শুধু ঘটনা তুলে ধরা নয়, বরং প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের দায়িত্বও বটে।
ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর তাণ্ডব
২০২৪ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ যখন বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে, তখন আমি ছিলাম মাঠে। মানুষের অসহায়ত্ব যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি বিপদের মুহূর্তে একে অপরকে সহযোগিতার চেষ্টা। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড জনপদ, পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি—সবই নিজের চোখে দেখা।
সংবাদ প্রকাশে হামলা ও হুমকি
পেশাগত ঝুঁকির মুখে সাংবাদিকতা শুধু সাফল্যের গল্প নয়, বরং কখনো কখনো ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতির মামলায় ১৬ আসামির কারাদণ্ড নিয়ে সংবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছি।
এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ তুলে ধরতে গিয়ে আহতও হয়েছি। কিন্তু এসব বাধা কখনো থামিয়ে দিতে পারেনি আমার সত্যের অনুসন্ধানের স্পৃহা।
সাংবাদিকতা শুধু তথ্য পরিবেশন নয়, এটি মানুষের কথা তুলে ধরার একটি মাধ্যম। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এখন মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্রাইপড, নোটবুক আর এই জনপদের প্রতিটি রাস্তা।
মোংলা বন্দরের উন্নয়ন আর ঐতিহ্যের সংযোগস্থল
দুই বছরের সাংবাদিকতায় মোংলা বন্দরের উন্নয়ন থেকে শুরু করে এখানকার ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছি। মোংলা শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরই নয়, এটি ইতিহাস-সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্রও।
উন্নয়ন আর ঐতিহ্যের মিশেলে মোংলা এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে, যা শুধু অর্থনীতিই নয়, পর্যটন ও সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করছে।
ঢাকা পোস্টে এই দুই বছরে অনেক কিছু শিখেছি, দেখেছি, অনুভব করেছি। প্রতিটি সংবাদ, প্রতিটি অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে নতুন কিছু। ভবিষ্যতেও নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যেতে চাই সত্যের অনুসন্ধানে, সমাজের দর্পণ হয়ে।
সাংবাদিকতা মানেই ঝুঁকি, বাবা-মা এখনো আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু সেই ঝুঁকি নিয়েই গড়ে তুলেছি দক্ষিণের প্রতিটি জনপদের সঙ্গে সম্পর্ক, মানুষের ভালোবাসা।
এই ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। সত্যের পথে থাকলে ভয় আসে, কিন্তু সেই ভয় জয় করার শক্তিও আসে মানুষের ভালোবাসা থেকে।
আরকে/এমজেইউ
লেখক : শেখ আবু তালেব, জেলা প্রতিনিধি (বাগেরহাট), ঢাকা পোস্ট