মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করেও ১৬ বছর কারাভোগ

আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দীর্ঘ ১৬ বছর কারাগারে থাকার পর বাড়ি ফিরেছেন চাঁদপুরের রবিউল আউয়াল (৩৮)। তিনি তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে (বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করতেন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআরের সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় তিনটি মামলা রবিউল আউয়ালকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালে তিনি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পান। তবে বিদ্রোহ আইনের মামলায় ৬ বছর সাজা এবং বিস্ফোরক মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে কারাবন্দি করে রাখা হয় প্রায় ১৬ বছর।
বিজ্ঞাপন
ফ্যাসিবাদী সরকার পালিয়ে যাওয়ায় গত ১৯ জানুয়ারি বাবুলসহ ১২৬ জনকে জামিন দেন আদালত। গত ২৩ জানুয়ারি তারা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন।
রবিউল আউয়াল চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার রায়ের কান্দি এলাকার মৃত আমির হোসেন এবং মমতাজ বেগম দম্পতির ছেলে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রবিউল ৪র্থ।
বিজ্ঞাপন
রবিউল আউয়ালের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মতলব উত্তর উপজেলার মোল্লা কান্দি লাল মিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি পাস করেন রবিউল। এরপর ২০০৬ সালের ৯ জুলাই যোগ দেন তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে সৈনিক হিসেবে। ওই পদে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করেন তিনি। এরপর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে পিলখানায় বিডিআর হাসপাতালে ১৮ মাসের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স প্রশিক্ষণ শেষ করে সেখানে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। এই পদে যোগদানের ছয় মাসের মাথায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।
ওই ঘটনার দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ২০০৯ সালের ৯ জুলাই তাকে তিনটি মামলায় কারাগারে যেতে হয়। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। এর মধ্যে বিদ্রোহ আইনের মামলায় ছয় বছর সাজা হয়। হত্যা মামলায় খালাস আপটু আপিলের ডিভিশন এবং বিস্ফোরক মামলায় দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ঢাকার কেরাণীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। তার বাড়ি ফেরার আনন্দে আত্মহারা পরিবার ও আত্মী-স্বজনরা। তাদের দাবি রবিউল যেন চাকরিটি ফেরত পায়।
বিজ্ঞাপন
রবিউল বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণেই মুক্তি পেয়েছি। এ গণ-অভ্যুত্থান যদি না হতো তাহলে একেবারে ধরেই নিয়েছিলাম জীবনে আর কখনো মুক্তি পেতাম না। সমন্বয়ক, দেশবাসীর কারণেই আমরা মুক্তি পেয়েছি। তাদেরকে ধন্যবাদ।
তিনি আরও বলেন, গত ১৬ বছরে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আমার নিজের বয়সটা হারিয়ে ফেলেছি। আমি অনেক স্বপ্ন নিয়ে এ চাকরিতে গিয়েছিলাম দেশের সেবা করবো, দেশের জন্য জীবন দেব। মা-বাবাকে সুখে রাখবো। আমরা গরিবের সন্তান, আমাদের তো আর কিছু চাহিদা ছিল না। চারটা ডাল, ভাত খাবো এবং বাবা-মা, পরিবারকে দেখে রাখবো। কিন্তু আমাদের জীবনটা ধ্বংস করে দিলো। এজন্য আল্লাহ তাদের বিচার করবে। আর একটাই চাওয়া, আমাদের হারানো চাকরিটা যেন ফিরে পাই। পরিবারের জন্য শেষ বয়সে কিছু করতে চাই।
রবিউল বলেন, জেলে থাকা অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছি। বাবার মৃত্যু কখনো মেনে নিতে পারি নাই। আমার জন্য বিদেশ যাওয়া অনেক সহজ ছিল। কিন্তু বাবার আদেশ ছিল বিডিআরে চাকরি করা। তার কারণে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকরিতে যোগদান করি। এ ছাড়া গত ১৬ বছরে আমার চাচা, ছোট চাচি, দাদা-দাদিসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন মারা গেছেন।
তিনি বলেন, চাকরিরত অবস্থায় বিয়ে করতে পারিনি। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিয়ে করতে হয়। আমার ওই সময়টার কিছুদিন বাকি ছিল। যার কারণে আমি বিয়ে করতে পারিনি।
মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রবিউল আউয়াল বলেন, বর্তমান সরকার বুঝতে পেরেছেন আমরা নিরপরাধ। আমাদের কোনো দোষ ছিল না। তারা আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। আমার অসংখ্য ভাইয়েরা এখনো কারাগারে আছেন। তাদেরকে মুক্তি দিতে হবে। তাদের চাকরিটা ফেরত দিতে হবে। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। আমরা ন্যায় বিচার চাই। কখনো জুলুম চাই না। বিচারের নামে প্রহসন চাই না। আমরা কারো কাছে কোনো আনুকূল্য চাই না। আমরা চাই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হোক। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যারা এই ঘটনার সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রকৃত খুনিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা বলছি, যারা অপরাধী তাদেরকে ছাড় দেওয়া যাবে না। আর যারা নিরপরাধ তাদের মুক্তি দিতে হবে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার দিন হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় ছিলাম। হাসপাতালে থেকে হঠাৎ করে শুনতে পাই গোলাগুলির শব্দ। হাসপাতালের ওপর থেকে সিনিয়রদের সঙ্গে নিচে এসে দেখি লোকজন দৌড়াদৌড়ি করতেছেন। এর মাঝে চিন্তা করলাম যে এটা তো সম্ভব না। কীভাবে, কী হচ্ছে। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। যারা অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
রবিউলের মা মমতাজ বেগম বলেন, গত ১৬ বছর ছেলেকে না দেখে বুকটা ফেটে গিয়েছিল। তিলে তিলে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ছেলেটা এখন ফেরত এসেছে নিজের কাছে খুবই ভালো লাগছে, আনন্দ লাগছে। আমার ছেলেটা যেন চাকরিটা ফিরে পায় সেজন্য সবার কাছে আকুতি করছি। আল্লাহ আমার সন্তানকে বুকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
রবিউলের ভাই মিজান বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আমার ভাই নিখোঁজ ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর জানতে পারলাম মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছোট ভাই গ্রেপ্তারের খবর শুনে বাবা স্টক করেন। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। বাবার একটা স্বপ্ন ছিল ছোট ভাইটাকে দেশের জন্য কাজে লাগাবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হলেও হয়রানির শিকার হয় ভাইটা।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইয়ের বর্তমান বয়স ৩৮ বছর। সে যখন চাকরিতে যোগদান করে তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। এক সময় আমাদের পরিবারটার অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। তখন সংসার চালানোর মতো কেউ ছিল না। ভাইটাই ছিল একমাত্র পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু তাকে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। ভাইয়ের এমন পরিস্থিতির কারণে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ি।
মিজান বলেন, আমরা এখন ভাইকে পেয়েছি। কিন্তু তার হারানো জীবন আর পাবো না। সে বাবাসহ আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছে। তাদেরকে ফেরত পাবো না। তার বয়সও শেষ। তার হারানো চাকরিটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। এটাই আমার বর্তমান সরকারের কাছে চাওয়া।
তার চাচাতো ভাই হাফেজ মিয়া বলেন, আমার চাচাতো ভাই চাকরি পাওয়ার দুই-আড়াই বছর পর মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন ১৬ বছর। সে এখন অসহায়ের মতো আছে। তার জীবনের ১৬টি বছর হারিয়েছে বিনা অপরাধে। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের চাচাতো ভাই চাকরি নিয়েছিল সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার জন্য। তাদের পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া যেন তার চাকরিটা ফেরত দেয়।
এএমকে