১৫ কেজি ওজনের মিষ্টি মিলবে যে মেলায়
![১৫ কেজি ওজনের মিষ্টি মিলবে যে মেলায়](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2025January/nowgaon1-20250128184758.jpg)
মিষ্টির কথা বললেই রসগোল্লা, রাজভোগ, কালোজাম, চমচমের নাম চলে আসে। তবে ‘বালিশ মিষ্টি’র সঙ্গে পরিচিত নন অনেকেই। অন্যসব মিষ্টি হরহামেশা মিললেও বালিশ মিষ্টির দেখা সব জায়গায় মেলে না। ওজনে বড় ও দামেও বেশি এই বালিশ মিষ্টি মিলবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার গুজিশহর গ্রামের প্রেম গোসাই মেলায়।
বিজ্ঞাপন
৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে এই প্রেম গোসাই মেলা। নিয়ামতপুর উপজেলার গুজিশহর গ্রামে গত ১৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই মেলা চলবে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গ্রামীণ মেলাটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘প্রেমতলীর মেলা’ নামেও পরিচিত। এই মেলার মূল আকর্ষণ বাহারি সব মিষ্টি। শুধু মিষ্টি নয়, চুড়ি, ফিতা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানান জিনিসও মেলে এই গ্রামীণ মেলায়।
আয়োজকদের দাবি- সারাদেশ থেকে মেলায় আসে মানুষ। মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘বালিশ মিষ্টি’। একটি মিষ্টির ওজন ১ থেকে ১৫ কেজি। যার দাম সাড়ে ৩০০ থেকে শুরু হয়ে ৬০০ টাকা পর্যন্ত ঠেকেছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই মেলায় প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। নওগাঁ ছাড়াও দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীরা আসেন ঐতিহ্যাবাহী এই গ্রামীণ মেলায়।
বিজ্ঞাপন
গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) গুজিশহরের প্রেম গোসাই মেলায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার দোকান বসেছে মেলা উপলক্ষ্যে। বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীরা জানান- মেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস বালিশ মিষ্টি। সেখান থেকে স্টোলগুলোর দিকে এগুতেই চোখে পড়ল বাহারি ডেকোরেশনে সাজানো মিষ্টির দোকানগুলো। সবচেয়ে বেশি ভিড় মিষ্টির দোকানে। মিষ্টি বানানো ও বিক্রি হচ্ছে ৫০টির বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। মেলায় প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন মিষ্টি বিক্রি হয়। পুরো মেলায় ১০টির বেশি মিষ্টির দোকানে ৩০ থেকে ৩৫ রকমের মিষ্টি পাওয়া যায়। এই মেলা বালিশ মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এই মিষ্টির একটির ওজন ১ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত। একেকটি মিষ্টির দাম পড়ে ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা।
মিষ্টি বিক্রেতারা ঢাকা পোস্টকে জানান, তাদের দোকানে রসগোল্লা, রাজভোগ, কালোজাম, চমচম, রসমালাই, প্রাণহরা, সন্দেশ, ছানামুখী, মণ্ডা, বুরিদান, মতিচুর লাড্ডু, কাঁচাগোল্লা রয়েছে। সব মিষ্টির মধ্যে বালিশ মিষ্টির কদর বেশি। তুলনামূলক বড় মিষ্টি। আর স্বাদেও অতুলনীয় হওয়ায় এর চাহিদা বেশি ক্রেতাদের কাছে। সাধারণ মিষ্টি দিনে ৫০ কেজি বিক্রি হলে বালিশ মিষ্টি ৭০ থেকে ৮০ কেজির বেশি বিক্রি হয়। যেসব দোকানে বালিশ মিষ্টি পাওয়া যায় বিক্রির দিক থেকে এমন চিত্র প্রায় সব দোকানে।
বিজ্ঞাপন
৬ কেজি ওজনের বালিশ মিষ্টির ক্রেতা রাকিবুল ইসলাম এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুপুরে মেলায় প্রবেশ করেছি। পুরো মেলা ঘুরলাম। তেমন ভালো লাগেনি। তবে মিষ্টির দোকানে এসে মন ভোরে গেছে। এখানে এক কেজি ওজনের বালিশ মিষ্টি খেলাম দুই বন্ধু মিলে। আর ৬ কেজি ওজনের দুইটা মিষ্টি দুজনে কিনে নিলাম বাড়ির জন্য। মূলত এই গ্রামীণ মেলা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত।
বড় বড় মিষ্টির দোকানের একপাশেই চলে মিষ্টি তৈরি। দোকানের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কারিগর মিষ্টি তৈরির কাজ করছেন। গরম তাওয়ায় চলছে মিষ্টির উপকরণ জ্বাল দেওয়ার কাজ।
কারিগর মাইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, তারা পাঁচজন মিষ্টি তৈরির কাজ করেন। কেউ মিষ্টি তৈরি করেন। কেউ জ্বাল করেন চুলায়। কেউ কেউ উপকরণগুলো প্রস্তুত করেন। সব মিলে চলে মিষ্টি তৈরি। তবে ছোট মিষ্টি তৈরিতে সময় ও খরচ কম হয়। কিন্তু বালিশ মিষ্টি তৈরিতে সময় ও খরচ বেশি লাগে। তাই অন্যসব মিষ্টির তুলনায় এর দামও বেশি।
সফিকুল ইসলাম নামে আরেক কারিগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, বালিশ তৈরি হয় দুধ-ছানা, চিনি ও ময়দা দিয়ে। এছাড়া গরম মশলাসহ বিভিন্ন মশলা দেওয়া হয়। প্রথমে দুধের ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। মণ্ড দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন সাইজের বালিশ। পরে তা জ্বালানো হয় চিনির গরম রসে। আধাঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা জ্বাল করার পরে তৈরি হয় মিষ্টি।
গ্রামীণ এই মেলায় চুড়ি, ফিতা, আলতা, খাট, চেয়ার-টেবিলসহ গৃহস্থালির নানা জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। মেলায় শিশুদের নাগরদোলাসহ নানা খেলনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেলা শুরুর সময়ে গুজিশহর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় মূল মেলা বসতো। তবে মেলা শুধু মেলা প্রাঙ্গণেই সীমিত থাকেনি। পরবর্তী সময়ে আমন ধান কেটে নেওয়ার পর ফাঁকা পড়ে থাকা কৃষিজমির মাঠে বসেছে মেলার বিভিন্ন দোকানপাট। মেলায় বসানো হয়েছে সার্কাসের প্যান্ডেল। শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য একাধিক নাগরদোলা ও রাইড বসানো হয়েছে। মেলা ঘিরে জামাতা ও আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয় বাহারি পিঠা। মেলা থেকে মিষ্টি কিনে এনে মেয়ে, জামাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ানোর রেওয়াজ ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী।
মেলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থেকে কাঠের তৈরি খেলনা নিয়ে এসেছেন রমজান আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩৫ বছর থেকে মেলায় মেলায় কাঠের খেলনা বিক্রি করছি। এই মেলায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। বেচাকেনা ভালো হয়। ঐতিহ্য ধরে রেখেছে গুজিশহরের মেলাটি। এখন গ্রামগঞ্জেও আধুনিক সব পণ্যের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। তারপরও কাঠের আসবাবসহ গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় পণ্য মানুষ মেলায় কিনতে আসে।
গুজিশহর গ্রামের বাসিন্দা রাবেয়া বেগম (৭০)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হামাগের (আমাদের) জন্মের পর থ্যাকে (থেকে) এই মেলা দেখে আসোছি। হামাগের (আমাদের) বাপ-দাদারাও কতে (বলতে) পারেনি কবে থ্যাকি (থেকে) এই মেলা শুরু হছে (হয়েছে)। আগে এই মেলাতে মাটির তৈরি বাসনকোসন (আসবাবপত্র) পাওয়া য্যাত (যেত)। এখনো মাটির তৈরি বাসনকোসন লিয়ে (নিয়ে) কিছু কিছু দোকান বসে, কিন্তু আগের মতো লয় (না)। এখন হামাগের (আমাদের) এখিনে অনেক বড় মেলা বসে।’
মেলা নিয়ে প্রচলিত গল্প আছে বলে জানান স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা রনজিৎ কুমার প্রামাণিক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গুজিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একটি শতবর্ষী বটগাছ আছে। বটগাছের নিচে ৫০০ বছর আগে প্রেম গোসাই নামে একজন সাধু ছিলেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার কাছে মানুষ এসে প্রার্থনা করলে সেটা পূরণ হতো। আগে এই স্কুলের আশে পাশে অনেক জঙ্গল ছিল। মানুষের আশা-যাওয়া তেমন ছিল না। তবে তিনি থাকেন। কথিত আছে- তিনি এই বটগাছের পাশে এক রাতে একটি পুকুর খনন করেছিলেন। পুকুরের পাশে একটি কুয়া রযেছে। এই কুয়ার পানি এখনো সনাতন ধর্মালম্বীরা পান করে থাকেন মনের বাসনা পূরণের আশায়। তারপরও বিভিন্ন সময় ঠাকুরকে কেন্দ্র করে পৃথক চারটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে। যে মন্দিরগুলোতে ভক্তরা সব সময় আরাধনা করেন। সেখান থেকে শুরু হয় মেলা। শুরু সময়ে এই মেলা ছিল। এরপর একদিনের মেলা হয়। সেই মেলা সাত দিন পর্যন্ত বর্ধিত হয়। আস্তে আস্তে ১৫ দিন। তারপরে সেটা দাঁড়ায় একমাসে। এখন এই মেলা চলে একমাস করে।
মেলা আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিনে মেলাটি বসে। চলে এক মাস ধরে। ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে একই দিনে মেলাটি বসছে। দূরদূরান্তের মানুষ এখনো আসে মেলায়। সে কারণে সব ধরনের সুবিধা রাখতে আয়োজক কমিটি প্রায় এক মাস আগে সব প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এই মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে গুজিশহর মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুলের উন্নয়ন করা হয়।
এ বিষয়ে নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনেছি এটা প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো একটা মেলা। প্রেম গোসাই নামে একজন সাধু ছিলেন এখানে। তার নামেই এই মেলা চলছে। এই মেলায় প্রতিদিন হাজারও মানুষের আগমন ঘটে। সবদিক থেকে বলতে গেলে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে এখানে মেলা চলছে।
আরএআর