চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিন দিনে ৯ জনের মৃত্যু, সংক্রমণের হার ৫১ শতাংশ
আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত এক সপ্তাহে ধরে হু হু করে বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। গত ৪৮ ঘণ্টায় প্রাণ গেছে আটজনের। গত ২৪ ঘণ্টায় র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ২০২ জনের মধ্যে ৯২ জনই করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে একজনের। তার আগের দিন ৯৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ ফলাফল আসে ৫২ জনের।
এদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই ছয়জন। গত রোববার (২৩ মে) ১০২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৯ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় দুইজনের। সবমিলিয়ে গত তিন দিনে রামেকসহ জেলায় মৃত্যুবরণ করেছেন নয়জন। করোনা সংক্রমণের হার প্রায় ৫১ শতাংশ।
সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে মঙ্গলবার (২৫ মে) থেকে জেলায় কঠোর লকডাউন দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। কঠোর লকডাউনের আওতায় জেলায় প্রবেশ ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগে শুরু থেকে সবচেয়ে কম সংক্রমণের জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে জেলাবাসী ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশি ও ভারতীয় ট্রাকচালকদের সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করছেন।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন জেলা আসা মানুষের প্রবেশ ও অসচেতনতা।
সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের দাবি, অবৈধ মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের যাওয়া-আসা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অনেকেই বলছেন, করোনার ভারতীয় ধরনের জন্যই এতো দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে জেলা সিভিল সার্জনের দাবি, এখনও ফলাফল এসে পৌঁছয়নি। তাই ভারতীয় ধরনের ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ দিয়ে সোমবার (২৪ মে) পর্যন্ত গত ৬ দিনে ৬৭ জন ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। ফেরত আসাদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল, জেলা পরিষদের শিবগঞ্জ উপজেলা ডাকবাংলো, জেলা শহরের হোটেল আল নাহিদ, রোজ আবাসিক হোটেলে এই ৬৭ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
স্কুলশিক্ষক আব্দুল খালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জেলায় এক সপ্তাহ আগেও তেমন কোনো সংক্রমণ ছিল না। কিন্তু যখন থেকে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তখন থেকে জেলায় সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিতে হতো। সামান্য কিছু মানুষের জন্য এখন বিপদে পড়েছে জেলার ২০ লাখ মানুষ। এমনকি তাদের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সারাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের একজন নিরাপত্তা প্রহরী জানান, ভারতীয় ট্রাকচালকদের মাঝে তেমন কোনো সচেতনতা নেই। বাংলাদেশে তাদের ট্রাক প্রবেশের পর এদেশের ট্রাকচালক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে তারা মেলামেশা করছে। হোটেলে-দোকানে খেতে যাচ্ছে।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের এক আমদানি-রফতানিকারক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পণ্য আনা নেওয়ার বিভিন্ন কাজে স্থলবন্দরে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়। ভারতে যেহেতু করোনারভয়াবহ অবস্থা, সেহেতু চালকদের করোনা পরীক্ষার পর বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দিতে হতো। কিন্তু সেটা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। জেলায় ভারতীয় চালকদের অবাধে চলাফেরাকে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা সাকিব আলী বলেন, সীমান্ত বন্ধ থাকলেও অবৈধ চোরাকারবারিরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে। কারণ তারা দিনের বেলায় সবার সঙ্গে মেলামেশা করে।
রেড ক্রিসেন্টের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার যুব প্রধান সুমাইয়া ইসলাম বলেন, গত এক বছরের তুলনায় এক সপ্তাহে কয়েক গুণ বেশি করোনা সংক্রমণ হয়েছে ও মানুষ মারা গেছে। ঈদে বাড়ি আসতেই হবে এমন মানসিকতা থেকে অনেকেই ট্রাকে গাদাগাদি করে বাসায় ফিরেছেন। এমনকি ঈদের সময় অবাধে চলাফেরা করা ও জনসচেতনতার অভাবেই করোনা সংক্রমণ বাড়ছে।
স্থানীয় প্রশাসন আরও কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিলে এমন ভয়াবহ অবস্থা হতো না উল্লেখ করে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সোনামসজিদ স্থলবন্দরের পানামা পোর্ট ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম জানান, জেলার করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। ভারতীয় চালকদের আলাদা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ভারতীয় চালকদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিশ্চিত করা না গেলে আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে।
শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়েরা খান মবিন ঢাকা পোস্টকে জানান, ঈদের পর থেকে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ জ্বর, সর্দি-কাশি ও গলা ব্যথা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসছে। এদের মধ্যে বয়স্ক নারী-পুরুষ ছাড়াও শিশুরা রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা চালু রেখেছেন। আগতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাপত্র দিয়ে নিজ নিজ বাড়িতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবস্থান করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যারা হাসপাতালে আসছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে করোনার উপসর্গ রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। মাস্ক না পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় ট্রাকচালকরাও অন্যতম একটি কারণ। আগামী এক সপ্তাহে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ ঢাকা পোস্টকে জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় সাতদিনের কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়েছে। জনসচেতনতার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। তারপরেও কেউ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর