গরু-ছাগলের সঙ্গে থাকতে হবে না ফেলানীকে
স্বামী-সন্তান সবই আছে ফেলানী বেওয়ার। নেই শুধু নিশ্চিন্তে রাত কাটানোর একটি ঘর। নিজের জমিজমা না থাকায় মাসের পর মাস গোয়াল ঘরে গরু-ছাগলের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা। অভাব অনটনের সংসারে অনেক কষ্টে তিন ছেলেকে বড় করেছেন।
ছেলেরা নিজেদের থাকার বন্দোবস্ত করলেও বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। অসহায় ফেলানী জীবনের পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে সেই ছেলেদের ঘরেই ঠাঁই নেন। কিন্তু ছেলেদের থাকার ছোট ঘরে ঠিকমতো রাত কাটানোর মতো কোনো জায়গা ছিল না।
রোজই রাত হলে ঘুমানোর ঘর খোঁজা নিয়ে বিড়ম্বনা বাড়তে থাকতে ফেলানীর। একটু প্রশান্তির ঘুমের জন্য একেক দিন একেক ছেলের ঘরের দুয়ারে যেতে হতো স্বামী-স্ত্রীকে। এর মাঝেই দুই পা প্যারালাইজড হলে পঙ্গু হয়ে পড়েন ফেলানী বেগম। কিছুদিন চিকিৎসা করা হলেও অর্থের অভাবে সুস্থতার হাল ছেড়ে দেন ছেলেরা।
এরপর বৃদ্ধা ফেলানীর ঠাঁই হয় গরু-ছাগলের গোয়াল ঘরে। সেখানে ফেলানীর স্বামীর মাথা গোঁজার জন্য একটা চৌকি থাকলেও পঙ্গু ফেলানীর জন্য কিছুই ছিল না। দিনে-রাতে গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগীর পাশে বস্তা বিছিয়ে ঘুমাতে হতো ফেলানীকে। এভাবেই দেড় বছর ধরে গোয়াল ঘরে থাকতে হয় বৃদ্ধা ফেলানী ও তার স্বামীকে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে ফেলানীর দুর্বিষহ জীবনযাপন নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। যেখানে গরু-ছাগলের সঙ্গে রাত্রিযাপন করা ফেলানীর দুঃখ-কষ্ট ও অসহায় জীবনের কথা উঠে আসে। ফেসবুকে দেওয়া পোস্টটি রংপুর জেলা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারের চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বৃদ্ধা ফেলানীর খোঁজ নেন।
এসপি বিপ্লব কুমার সরকারের নির্দেশে সহকারী পুলিশ সুপার (এসএএফ) আশরাফুল আলম পলাশ গত ১৩ মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফেলানীর বাড়িতে যান। সেখানে তাকে চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও চিকিৎসার জন্য কিছু নগদ সাহায্য দেন। ফেলানীর সঙ্গে কথা বলে তার দুরবস্থার আদ্যোপান্ত জেনে নেন। পুরো বিষয়টি অবগত হয়ে পুলিশ সুপার পঙ্গু ফেলানীর জন্য একটি হুইল চেয়ার ও তাদের স্বামী-স্ত্রীর থাকার জন্য আলাদা একটি ঘরের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ৭ নম্বর লতিবপুর ইউনিয়নের অভিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা ফেলানী বেগম। স্বামী আকাব্বর হোসেন (৯০) ও তিন ছেলেকে নিয়ে ওই গ্রামে ফেলানীর বসবাস। তার স্বামীও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। অভাবের কারণে অসহায় জীবনযাপন করতে হয় বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীকে।
সোমবার (২৪ মে) সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারের পক্ষে আশরাফুল আলম পলাশ বৃদ্ধা ফেলানীর বাড়িতে একটি হুইল চেয়ার নিয়ে হাজির হন। সেখানে ফেলানী ও তার অসুস্থ স্বামীকে গোয়াল ঘরের জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের থাকার ঘর তৈরির ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, তিন ছেলে সন্তানকে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণ ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।
পুলিশ সুপারের এই মানবিকতা দেখে পঙ্গু ফেলানী, তার বৃদ্ধ স্বামী আকাব্বর ও তিন ছেলে আনন্দে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। মাটিতে পড়ে থাকা পঙ্গু ফেলানী বেওয়া পুলিশ সুপারের উপহার পেয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইজ কদ্দিন থাকি গোয়াল ঘরোত মাটিত পড়ি আঁচো, কাঁয়ও দেকে না। গরু -ছাগলের সাথে এটে পেচ্ছাব-পায়খানা করোং। একনা ভালো মন্দও খাবার পাঁওনা। ওষুধ নাই। চিকিৎসাপাতি নাই। আল্লায় এসপি স্যারক বাঁচে থুক। তায় মোর জনতে অনেক কিছু করি দিলে। নয়া ঘর পানু। একটা হুইল চেয়ারও দিচে। এ্যলা মোর আর কোনো কষ্ট থাকিল না।
ফেলানীর ছোট ছেলে রিফুল মিয়া ঢাকা পোস্টকে জানান, বছর খানেক আগে তার মায়ের দুই পা প্যারালাইজড হয়। এখন তিনি পঙ্গু। বয়সও হয়েছে। কোনো কাজ করতে পারেন না। নিজেদের সামর্থ্য না থাকায় বৃদ্ধা মা-বাবার জন্য ঘর তৈরি করতে পারেননি।
অন্যদিকে স্থানীয়রা বলছেন, এসপি বিপ্লব কুমার সরকারের মানবিকতার কারণেই প্রায় দেড় বছর পর গোয়ালঘরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলেন বৃদ্ধা ফেলানী ও তার স্বামী। একইসঙ্গে মাটিতে পড়ে থাকা ফেলানী পেলেন বাসযোগ্য ঘর ও হুইলচেয়ার। এখন ফেলানী চেয়ারে বসে ঘুরে দেখবেন তার পৃথিবী। এটা আনন্দের ব্যাপার।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সমাজে ফেলানীর মতো অনেক অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন। এসব মা-বাবার জীবনে সন্তানদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু তাদের জীবনের পড়ন্ত বেলায় এ রকম কষ্ট অবহেলা দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, আমি যা করেছি, এটা আমার দায়িত্ব থেকে করেছি। সবার উচিত তাদের আশপাশের এমন অসহায় মানুষের খোঁজখবর নেওয়া। সামর্থ্য অনুযায়ী সবার একটু একটু করে এগিয়ে আসা। সমাজটা মানবিক হলে একটা সময় দুঃখে-কষ্টে থাকা মানুষের খোঁজ মিলবে না।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএইচ