১০ বছর ধরে বন্ধ রেডিওথেরাপি, ক্যান্সারে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের রেডিওথেরাপি মেশিন ১০ বছর ধরে নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। এতে করে রংপুর বিভাগের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা এ হাসপাতাল থেকে রেডিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে পারছে না। অনেকেই সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে অকালে মারা যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে অসংখ্যবার চিঠি দেওয়ার পরও রেডিওথেরাপি মেশিন চালু করা বা নতুন করে মেশিন স্থাপনে কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। বাধ্য হয়েই চিকিৎসকরা রোগীদের বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯৯৭ সালে এই হাসপাতালে স্থাপন করা হয় রেডিওথেরাপি কোবাল্ট-৬০ নামে একটি মেশিন। ২০০১ সালে চালু করা হয় এটি। মেশিনটি ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সচল ছিল। এরপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে রংপুর বিভাগ ছাড়াও অন্য বিভাগ থেকেও ক্যান্সার আক্রান্ত অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে এই হাসপাতালে, যাদের বেশিরভাগই স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ ছাড়া ফুসফুস ও কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও আছে।
কলেজ ও হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত ছয় হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই ২ হাজার ৮৪৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। যার মধ্যে রংপুর জেলারই ছিল ১ হাজার ৩৮৯ রোগী।
এদিকে প্রায় এক দশক ধরে রেডিওথেরাপি চিকিৎসা বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগের আট জেলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হাজারো রোগী কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এর ফলে আক্রান্ত রোগীদের ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকিও।
সরেজমিনে রমেক হাসপাতালে যা দেখা গেল
মূল হাসপাতালের বাইরে পশ্চিম পাশে একতলা একটি ভবনে রেডিওথেরাপি মেশিনটি স্থাপন করা হয়েছিল। ভবনটি বর্তমানে তালাবদ্ধ। সেখানে একটি কক্ষে কোবাল্ট-৬৬ যন্ত্রটি অযত্নে পড়ে আছে। পাশের কক্ষে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কয়েকটি মনিটর। কাপড়ের ওপর ধুলোর আস্তর জমে আছে।
বর্তমানে হাসপাতালে কেমোথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মাত্র দুজন চিকিৎসক নির্ভর ১৪ শয্যার কেমোথেরাপি বিভাগ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ক্যান্সার রোগীদের দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষা। অনেকেই ক্যান্সারের কেমোথেরাপি নিচ্ছে। তাদের একজন হাফিজুর রহমান (৪৯)। তিনি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা থেকে রংপুর মেডিকেলে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য এসেছেন। তিনি প্রায় দেড় মাস সেখানে হোটেলে থেকে ৩০ সাইকেল থেরাপি নিয়েছেন। এতে তার চিকিৎসার খরচ বেড়ে গেছে। রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দ্রুত চালু করা গেলে তার মতো অন্যরাও উপকৃত হবেন বলে মনে করছেন এই রোগী।
একই জেলার তেঁতুলিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মিজানুর রহমান (৫৫) জানান, গলায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। অস্ত্রোপচারের পর ছয় সাইকেল কেমোথেরাপি নিয়েছেন। কিন্তু টাকার অভাবে রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন না।
রেডিওথেরাপি পাচ্ছেন না রোগীরা
হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসক মনি রানী জানান, ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৯০ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। গড়ে কেমোথেরাপি নেন ৪০ জন। অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি থাকেন ১০ থেকে ১৫ জন। এ হিসাবে বছরে অন্তত ৪০ হাজার ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশের রেডিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রংপুরে বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলা থেকে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের রোগী ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের রোগী ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, গ্রুপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনালীর ক্যান্সারের রোগী ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সারের রোগী ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
ক্যান্সারের চিকিৎসা জটিল হওয়ায় কারও ক্যান্সার ধরা পড়ার পর রোগী ও রোগীর আত্মীয়-স্বজন মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন। ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা করা হয়, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এরপর ক্যান্সার চিকিৎসা, সেটাও বেশ ব্যয়বহুল।
রংপুরের পীরগাছার নূর বানু (৩৫) নামে ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগীর স্বজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে গলায় ক্যান্সার রোগে ভুগছেন তার খালা। জমিজমা বিক্রি করে ৫ বার কেমোথেরাপিও নিয়েছেন। রেডিওথেরাপির জন্য চিকিৎসকরা বললেও হাসপাতালের একমাত্র মেশিনটি বিকল থাকায় চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
নূর বানুর মতো আরও অনেকেই আছেন এই হাসপাতোলে। রেডিওথেরাপি দিতে না পাড়ায় ধুঁকছেন রোগ যন্ত্রণায়। কুড়িগ্রাম থেকে আসা জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত এক গৃহবধূর স্বামী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদিন রংপুরে এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে রংপুরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার বলছে, থেরাপি লাগবে। মেডিকেলে আসি শুনি মেশিন নাই।
রেডিওথেরাপির অভাবে রোকেয়ার মৃত্যু
রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট থাকায় কীভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছেন, এর বাস্তব প্রমাণ রোকেয়া বেগম। গত বছর ৬০ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম নীলফামারী থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে আসেন। সেখানকার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করে ও যাবতীয় রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানান, তার জরায়ুমুখের ক্যান্সার তৃতীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এ অবস্থায় তাকে দ্রুত রেডিওথেরাপি দিতে হবে। রোকেয়া বেগমের স্বামী দ্রুত রেডিওথেরাপি শুরু করার অনুরোধ জানান। কিন্তু রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট থাকায় রংপুরে তাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য রোকেয়া বেগমকে ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেফার করা হয়।
এরপর রোকেয়া বেগমের স্বামী এলাকার লোকজনের কাছে টাকা ধার করে ঢাকায় যান। সেখানে ভিড় বেশি থাকায় রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য চার মাস পর সিরিয়াল দেওয়া হয়। রোকেয়া বেগমের স্বামী চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, অন্য কোনো চিকিৎসা বা অন্য কোনো জায়গায় রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় কি না। চিকিৎসক জানান, বেসরকারি পর্যায়ে দ্রুত রেডিওথেরাপি দেওয়া যায়, কিন্তু সেখানে একবার রেডিওথেরাপি দিতে লাগে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। রোকেয়া বেগমের স্বামীর পক্ষে এত টাকার ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নীলফামারীতে ফিরে যান, অপেক্ষায় থাকেন সিরিয়ালের। এর মধ্যে রোকেয়া বেগম আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চার মাস অপেক্ষার পর সিরিয়াল আসে রেডিওথেরাপির। রেডিওথেরাপির জন্য রোকেয়া বেগম তখন উপযুক্ত কি না এবং ক্যান্সারের পর্যায় নির্ণয় করার জন্য পরীক্ষা করেন চিকিৎসকেরা। পরীক্ষায় দেখা যায়, এই চার মাসে রোকেয়া বেগমের ক্যান্সার তৃতীয় থেকে চতুর্থ পর্যায়ে চলে গেছে এবং এ পর্যায়ে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় না। এরপর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে রোকেয়া বেগমকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য রেফার করা হয়। সঠিক সময়ে রেডিওথেরাপি না দেওয়ায় কিছুদিন পর মারা যান রোকেয়া বেগম।
সম্প্রতি রেডিওথেরাপির অভাবে রোকেয়া বেগমের মৃত্যুর এ তথ্যটি গণমাধ্যমে তুলে ধরেন প্রাইম মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল। ক্যান্সার গবেষক এ চিকিৎসক জানান, রোকেয়া বেগম হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, যদি রংপুরে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন থাকত। তাহলে ক্যান্সারনির্ণয় হওয়ার পরপরই তিনি রেডিওথেরাপি চিকিৎসা পেতেন এবং আজও পৃথিবীতে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারতেন।
রেডিওথেরাপি মেশিনে চিকিৎসা ব্যয়
সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর রেডিওথেরাপি বাবদ প্রতি ধাপে খরচ হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে রোগের ধরণ অনুযায়ী ২৫ থেকে ৩০ দিন রেডিওথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হয়। সেক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে রেডিওথেরাপির জন্য গড় ব্যয় ৬ থেকে ২০ হাজার টাকা, অন্যদিকে একই রেডিওথেরাপি বেসরকারি পর্যায়ে ১ থেকে ৩ লাখ টাকা। এত উচ্চ ব্যয় ক্যান্সারের অধিকাংশ রোগী বহন করতে পারেন না।
উত্তরবঙ্গে যেসব হাসপাতালে রেডিওথেরাপি আছে
বৃহত্তর রংপুর বিভাগের আট জেলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল। এ বিভাগের আট জেলার রোগীদের জন্য নিকটবর্তী হিসেবে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল, কিন্তু দেড় বছর ধরে সেটিও বিকল হয়ে আছে। তাই বৃহত্তর রংপুরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসা হলো ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে চার থেকে ছয় মাসের আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সচল থাকলেও সেখানে রাজশাহীর রোগী অনেক বেশি হওয়ায় বাইরের রোগীরা সুযোগ পান না।
ক্যান্সারের চিকিৎসার ধরণ
ক্যান্সার গবেষকদের মতে, যে কোনো ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি আছে- অপারেশন, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। রেডিওথেরাপি ক্যান্সারের একটি অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। রেডিওথেরাপি এককভাবে অথবা অপারেশন বা কেমোথেরাপির সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়।
যেসব ক্যান্সারের জন্য রেডিওথেরাপি চিকিৎসা জরুরি সেগুলো হলো মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ব্রেনের ক্যান্সার, জরায়ু ও জারায়ু মুখের ক্যান্সার, মলদ্বারের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও ত্বকের ক্যান্সার। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রেডিওথেরাপির পাশাপাশি ব্রেকিথেরাপি ও লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর মেশিন প্রয়োজন। সেসব যন্ত্রও নেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
রমেকে রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন
১৯৯৭ সালে রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপির জন্য পাঁচটি কোবাল্ট-৬৬ মেশিন স্থাপন করা হয়। তিন বছর পর আনবিক কমিশন কর্তৃপক্ষ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের থেরাপি মেশিনটি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য অনুমতি দেয়। বিদেশি সাহায্য সংস্থার ১৪ কোটি টাকার অনুদানে এই পাঁচটি কোবাল্ট-৬৬ মেশিন ওই সময় পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন ও চালু করা হয়। রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু হয় ২০০১ সালের দিকে।
চীনের তৈরি এই মেশিনগুলো সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকার ‘মার্ডেল এজেন্সি’ সরকারের কাছে অনুমতি পায়। এই কোবাল্ট মেশিন চীন থেকে আনা হলেও ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য যে সোর্স (যে উৎস থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ ঘটে) তা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই সোর্স পরিবর্তন করতে হয়। কারণ এর কার্যকারিতা পাঁচ বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এরপর তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
কোবাল্ট মেশিনটিতে সর্বশেষ সোর্স স্থাপন করা হয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালে নতুন করে সোর্স স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি। ক্যান্সার রোগীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও রংপুর মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রটি দিয়ে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
কার্যাদেশে চারটি মেশিনের আনুষঙ্গিকসহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫০ লাখ ১১ হাজার ২৩২ মার্কিন ডলার। পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাসহ বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩৯ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৭৬ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি মেশিনের মূল্য পড়ছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। যন্ত্রটি ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। হাসপাতালে নতুন মেশিন স্থাপনের কথা থাকলেও কবে নাগাদ তা হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোর যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) একাধিকবার পত্র দেওয়া হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার পত্র দেওয়ার পরও কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পত্রের ফিরতি কোনো উত্তরও পাচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসক ও পরিচালক যা বলছেন
ক্যান্সারের রোগীর যে কষ্ট, যে ধরনের চিকিৎসা-ফলোআপ, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না উল্লেখ করে রমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক জাহান আফরোজ খানম জানান, ২০০১ সালের ১২ জুন রেডিওথেরাপি মেশিন বসানো হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত মেশিনটি চালু ছিল। তখন প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের বেশি রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১৫ সালে মেশিনটি অচল হয়ে পড়লে তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কয়েকবার তাগাদা দেন। কিন্তু রেডিওথেরাপি যন্ত্রটি আজো চালু করা সম্ভব হয়নি।
ক্যান্সার গবেষক প্রাইম মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল বলেন, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে এ অঞ্চল বারবার পিছিয়ে থাকছে। বিশেষ করে ক্যান্সারে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারেন না। তাই সরকারি হাসপাতালের সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা অথবা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া রংপুরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের অন্য কোনো উপায় নেই। বৃহত্তর রংপুরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কমপক্ষে দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক যেন সচল থাকে, সে ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, নতুন রেডিওথেরাপি মেশিনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিগগিরই কথা বলা হবে। এর আগের পরিচালকরাও একাধিকবার চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। কেমোথেরাপি রোগীদের কক্ষ সংকট লাঘবে আগামী দুই মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
আরএআর