ভ্যান ভাড়া উঠাতে ২ টাকা পিস ফুলকপি বিক্রি করলেন কৃষক
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারে ফুলকপি বিক্রি করতে আসেন কৃষক হারুনুর রশিদ। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও পাইকারি ব্যাপারীদের কাছে তা বিক্রি করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ভ্যান ভাড়া উঠাতে নিজেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দুই টাকা, তিন টাকা এবং সর্বোচ্চ চার টাকা দামে বিক্রি করেন সেই ফুলকপি।
হারুনুর রশিদ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীননগর গ্রাম থেকে ডাকবাংলা বাজারে ফুলকপি বিক্রি করতে এসেছেন। তার মতো অনেক কৃষক আশপাশের এলাকা থেকে ডাকবাংলা বাজারে সবজি বিক্রি করতে এসেছেন। কেউই সবজি বিক্রি করে হাসিমুখে ফিরতে পারেনি।
পৌষের শেষ দিকে শীতের দাপট বেড়েছে। তবুও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মাঠে শীতকালীন সবজির উৎপাদন বেড়েছে। জেলায় মাঠের পরে মাঠজুড়ে শীতকালীন সবজির চাষ। বাজারেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। শাক-সবজির দাম কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। সবজির দাম বর্তমানে কম হলেও আগাম সবজি চাষিরা অনেক খুশি। তবে শীতকালে সবজি চাষিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস বলছে, যারা আগাম সবজি চাষ করেছেন তারা ভালো দাম পেয়ে লাভবান হয়েছেন। আর যারা শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন তারা একটু দাম কম পাচ্ছেন।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন মাঠে শীতকালীন সবজির ভরপুর আবাদ লক্ষ্য করা গেছে। হরিনাকুন্ডু উপজেলার দৌলতপুর , কাপাশাটিয়া, চাঁদপুর ইউনিয়ন, সদর উপজেলার সাধুহাটি, মধুহাটি , সাগান্না, হলিধানী ইউনিয়নসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ উপজেলাতে শীতকালীন সবজির ব্যাপক আবাদ হয়েছে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, টমেটো, লাউ, বেগুন, পালংশাকের উৎপাদন ভালো হওয়ায় খুশি কৃষকরা। তবে দাম কম হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় ১২ হাজার ৫৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলাতে ২ হাজার ৩৬০ হেক্টর, কালীগঞ্জে ১ হাজার ৫৬০ হেক্টর , মহেশপুর ২ হাছার ৮৫ হেক্টর , কোটচাঁদপুর ১ হাজার ২৪৯ হেক্টর, শৈলকুপাতে ৩ হাজার ৭৬৬ হেক্টর এবং হরিণাকুন্ডুতে ১ হাজার ৩৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ করা হয়েছে।
কৃষক মো. হারুনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। বাজারে পাইকারি বিক্রি করতে পারছি না। ডাকবাংলা বাজারে ভোরে ভ্যানে করে ফুলকপি বিক্রি করতে আসছি। সকাল ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও পাইকারি বিক্রি করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ২ টাকা, ৩ টাকা, ৪ টাকা যে যা দিচ্ছে তাই নিয়েই বিক্রি করে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, দোকান থেকে যে বীজ নিয়েছি, এখনো পর্যন্ত বীজের দাম পরিশোধ করতে পারিনি। ২৫ হাজার টাকা খরচ করেছেন। দেড় বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। অর্ধেক অংশ থেকে ১২ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি, খরচের দামও হয়নি। বাজারে আসতে যে গাড়ি ভাড়া দিব সে টাকাও হচ্ছে না। এখন বাধ্য হয়েই সবজিগুলো নষ্ট করে দিতে হবে।
সদর উপজেলর গিলাপোল গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বছর শীত থাকলেও সবজির আবাদ ভালো হয়েছে। সবজির আবাদে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। শীতকালীন বৃষ্টিও হয়নি। যে কারণে ফলন অনেক ভালো হয়েছে। তবে বাজারে সবজির দাম কম।
ঝিনাইদহের শৈলকূপার মদনডাঙা, চড়িয়ারবিল, মির্জাপুর, চাঁদপুর, কাচেরকোল গ্রামসহ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের মাঠেই শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। সবজির উৎপাদন বেশি হওয়ায় স্থানীয় বাজারগুলোতে যোগান বেড়েছে। ফলে শীতকালীন সবজির দাম অনেকটা কমে গেছে। জেলার অন্যান্য উপজেলার চিত্রও একই।
সদর উপজেলার ডাকবাংলা পাইকারি সবজি বাজারে ঢাকা থেকে আগত ব্যবসায়ী আতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, বেগুন, নতুন আলু, শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বরবটি, পেঁয়াজের দাম অনেক কমে গেছে। বাজারে এখন মালের আমদানি বেশি। কৃষকও খুশি, ক্রেতারাও খুশি।
কৃষক রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাঁধাকপি ফুলকপি পাইকারি ৫-১০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। মরিচের দামও কমেছে। শিম নিয়ে আসছি ৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।
সরেজমিনে সদর উপজেলার ডাকবাংলা, নগরবাথান, গান্না ও হলিধানী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শাক-সবজির পাইকারি বাজারগুলোতে ফুলকপি ৫ টাকা পিস, বেগুন ১৫ টাকা কেজি, লাউ ১৫-২০ টাকা পিস, শিম ৫-১০ টাকা, টমেটো ৩৫ টাকা, পেঁয়াজের কালি ১৫ টাকা, আলু ৩৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ৫০ টাকা, পেঁয়াজ ৫৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও করলা ৩৫ টাকা, গাজর ৩০ টাকা, শসা ৩০ টাকা কেজি, পালং শাক ৩ টাকা আঁটি ও বাঁধাকপি ১৫ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। এসব সবজি খুচরা বাজারে বা গ্রামীণ হাটে খুচরা পর্যায়ে কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা৷
সদর উপজেলার হলিধানী বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা লাল্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবজির দাম পাইকারি বাজারে কমে গেছে। খুচরা বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। শাক-সবজির ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন অনেক বেশি। বর্তমান কাঁচামালের বাজার স্বাভাবিক। কৃষকের কাছ থেকে যেমন দামি ক্রয় করা হচ্ছে, তার থেকে পাঁচ থেকে ১০ টাকা করে লাভে বিক্রি করা হচ্ছে।
হলিধানী বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা মো. রেন্টু আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবজির দাম কমে গেছে। ক্রেতারা খুশি। তবে কৃষক এখন খুব একটা দাম পাচ্ছে না। গত এক সপ্তাহ ধরে সবজির বাজার স্বাভাবিক। কোনো ধরনের কাঁচা সবজির দাম বাড়েওনি আবার কমেওনি।
ডাকবাংলা বাজারে সবজি নিয়ে আসা হরিণাকুন্ডু উপজেলার মহারাজপুর মানোয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগাম সবজিতে ভালো দাম পেয়েছি। এখন আর দাম নেই। ফুলকপি, মুলা, পেঁয়াজের কালি, পুঁইফলের দাম নেই বললেই চলে। আমি বেগুন নিয়ে এসেছি ১৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।
ডাকবাংলা বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ী সৌরভ ঢাকা পোস্টকে জানান, বাজার থেকে যেমন দামে সবজি ক্রয় করছি। কেজি প্রতি ৫ টাকা করে লাভে বিক্রয় করে থাকি। কিছু কিছু সবজি টমেটো, আলু এগুলো বাইরের জেলা থেকে আনতে হয়, এ কারণে খরচ একটু বেশি। আবার বাজারে টমেটোর চাহিদা থাকায় পাইকারি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি বিক্রয় করছি।
বাজারে আসা সবজি ক্রেতা মন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজরের বড় দোকানগুলোতে দাম কমাতে চায় না। তারপরও কম দামে সবজি কেনা যাচ্ছে। কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, নতুন আলু বেগুন, শিমসহ শীতকালীন সবজির দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। কিছু কিছু সবজির দাম নেই বললেই চলে।
হলিধানী হাট-বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবজির বাজারে স্থানীয় পর্যায়ে যেন কারসাজি বা সিন্ডিকেট গড়ে না ওঠে সেজন্য আমরা প্রশাসনের পাশাপাশি সজাগ রয়েছি। কৃষক ও সাধারণ মানুষ যেন না ঠকে এ কারণে বাজারগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করি। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগত যে কোনো উদ্যোগ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. নূর-এ-নবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার শাক সবজির ফলন ভালো হয়েছে। তবে বর্তমানে মাঠে শীতকালীন সবজির উৎপাদন বেশি, এ কারণে সবজির বাজার অনেকটাই কম। তবে কৃষক আগাম সবজিতে ভালো দাম পেয়েছেন। শীতকালীন সবজি বাজার যদি ভালো হতো তাহলে কৃষকেরা সবজি চাষে আরও বেশি আগ্রহী হতেন।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর